
বিজ্ঞ-অনবিজ্ঞের গল্প ও অর্থের পাঁচালি
কথিত আছে যে দুই অর্থনীতিবিদ, একজন অভিজ্ঞ ও অন্যজন অনভিজ্ঞ, কোনো এক বিকেলে পথ ধরে হাঁটছিলেন। দেখতে দেখতে তাঁদের সামনে পড়লো একটা গোবরের স্তূপ। অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বললেন, “তুমি যদি স্তূপে থাকা গোবর খেতে পারো তাহলে তোমাকে আমি বিশ হাজার ডলার দেব।” অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ চিন্তা করে দেখলেন, গোবর খেয়ে যদি বিশ হাজার ডলার পাওয়া যায় তো এই দুর্মূল্যের বাজারে তাই বা কম কীসের। অনেক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে শেষমেষ তিনি গোবর খেয়ে প্রতিশ্রুত অর্থ আদায় করে নিলেন। কিছুদূর যেতেই আরেকটা গোবরের স্তূপ তাঁদের সামনে পড়লো। এবার অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ বললেন, “তুমি যদি স্তূপে থাকা গোবর খেতে পারো তা হলে তোমাকেও আমি বিশ হাজার ডলার দেব।” এই কথা শুনে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ভাবলেন, কোনোদিনতো বাজিতে হারিনি; কিছুক্ষণ আগে হেরে গিয়ে বিশ হাজার ডলার খোয়ালাম। বেইজ্জতের ব্যাপার! নাহ্, আমাকে ঐ অর্থ ফেরত আনতেই হবে। অনেক হিসাব করে সেও স্তূপে থাকা গোবর খেয়ে বিশ হাজার ডলার ফিরে পেলেন। তারপর চলার পথে অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ আক্ষেপের সুরে বলছেন, “খামোখাই কিন্তু আমরা গোবর খেলাম। আমাদের দু’জনের অর্থের অবস্থা আগের মতোই; কোনো উন্নতিই হয়নি, একদম পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়।”
অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ একটা বিজ্ঞের হাসি দিয়ে জানান দিলেন, “উন্নতি হয়নি মানে? ইতিমধ্যে ৪০ হাজার ডলারের মতো অর্থের লেনদেন হয়েছে সেটা কী কম কথা ?” এই কথা শুনে অনভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ গোবরগণেশের মতো অর্থ বিষয়ক গ্যাঁড়াকলে পড়ে যায়। তবে এই গ্যাঁড়াকল বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার আগে অর্থ সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
এক.
অর্থের নাম আস্থা । ইংরেজিতে যাকে বলে Money বাংলায় তাই টাকা। বর্তমান আলোচনার স্বার্থে আমরা আপাতত মুদ্রা, অর্থ ও টাকা সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। Money বা অর্থ বলা হয়ে থাকে এমন সম্পদকে সাধারণভাবে যা স্বীকৃত বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। খুব ভাল জীবনমানের আশায় বছরের পর বছর আপনি পরীক্ষায় পাস দিয়ে প্রতিমাসে টাকা নামে কিছু কাগজ হাতে পান কিন্তু খেয়াল করেননি বোধহয় যে এদের অন্তর্নিহিত কোনো দাম নেই। আপাতদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কাগজের নৌকা আর কাগুজে নোট বুঝি একই রকম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কাগুজে নৌকার উপর কিছু লেখা থাকে না (এবং থাকলেও তা বহনকারীর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নয়) কিন্তু কাগুজে মুদ্রার পিঠে “চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে” কথাটা লিখা থাকে। মজার কথা, যতক্ষণ পর্যন্ত না অর্থ হাতছাড়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থ কেবলই অর্থহীন।
যদি কোনো সমাজ স্বীকার করে নেয় বা গ্রহণ করতে রাজি থাকে, তা হলে রাবার ব্যান্ড বা চটি জুতাও পারে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের পাতায় আছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজে ক্যান্ডিবার, গরু, বিয়ার বা ওয়াইন, কপার, লৌহ, তামা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড এমনকি সিগারেটও বিনিময়ের মাধ্যম এবং অর্থ হিসাবে সেবা দিয়েছে । এগুলোকে বলে দ্রব্যজাত অর্থ বা কমোডিটি Money। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে অন্য সব দ্রব্য বিদায় নিলেও সিলভার ও স্বর্ণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মাঠে থেকে যায়। দ্রব্যজাত অর্থের প্রধান সুবিধা বা গুণ এই যে এদের অন্তর্নিহিত দাম থাকে (ইনট্রিনসিক ভেল্যু) যেমন, নারিকেল বা চাল কেউ না নিলেও নিজে খাওয়া যায়; গরু কেউ গ্রহণ না করলেও নিজের প্রয়োজন মেটানো যায়।
অন্য অর্থে, নারিকেল, চাল কিংবা গরুর বিক্রয়মূল্য থাকে। যাই হোক, সময়ের বিবর্তনে ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে বিনিময় এবং স্বভাবতই বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে উত্তরোত্তর স্বর্ণ-রূপার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু মুশকিল হলো ধাতব দ্রব্যের জোগান খুব সীমিত, কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যয়বহুল খনি খনন করে বের করতে হয়, এবং তার পরিমাণ কখনো খুব বেশি, কখনো খুব কম। অর্থাৎ, স্বর্ণ-রূপার অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও অনিশ্চিত জোগান বিনিময় ব্যবস্থাকে অসংযত করে রাখে যা আস্তে আস্তে মুদ্রার উপর আস্থা হ্রাস করে।
দুই.
একটা অর্থনীতিতে অর্থ চলে আস্থার উপর ভিত্তি করে। সমাজ বা সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে চলমান সম্পদটি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। একবার এক নাটকে দেখা গেল, হাড় কিপটে লোকটি বস্তায় বস্তায় টাকা জমিয়েছে কিন্তু হঠাৎ খবর পেলো যে সরকার এই টাকা বাতিল ঘোষণা করেছে (ডিমোনিটাইজড)। বাতিল করা মানে যে কোন কারণেই হোক প্রচলিত মুদ্রার উপর থেকে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্থা উঠে যাওয়া এবং সেই কারণে এই টাকা আর বিনিময়ে ব্যবহার করা যায় না। এই অবস্থায় বস্তার উপর মাথা রেখে কৃপণের কান্না কে দেখে, “তুই আমারে মাফ কইরা দেরে ট্যাহা, আমি তোর লাইগ্যা কিছুই করতে পারলাম না ... আল্লাহ তোর বেহেস্ত নসিব করুন ইত্যাদি।” প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, নানান কারণেই প্রচলিত মুদ্রা বাতিল হবার অনেক উদাহরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিশেষ মানের নোট বাতিল করেছিল এবং স্বাধীনতাত্তোর কালে, খুব সম্ভবত ১৯৭৪ সালে, এরূপ আর একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, আস্থা হচ্ছে মুদ্রার অস্তিত্বের প্রধান সোপান।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ