
অশ্রু আগুনে পুড়তে থাকা কাশ্মীর
২০১৩ সাল অবিভক্ত কাশ্মীরের জন্য গভীর শোকের। পর পর দুজন মানুষ দুটি রাষ্ট্রের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন; যার মধ্যে একজন ছিলেন নিখাদ সাধারণ কাশ্মীরি, আরেকজন কাশ্মীরি জনতার মুক্তির স্বপ্নের দিশারি। প্রথমজন আফজাল গুরু, তাঁকে গোটা দুনিয়া চেনে, যাঁকে ভারতের তিহার কারাগারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় প্রহসনের বিচারে। ২০০১ সালে ভারতের আইনসভায় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
আদালতে দাঁড়িয়ে আফজাল বারবার বলেছিলেন, তিনি কোনো সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু ভারতব্যাপী তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে তুষ্ট করতে বলির পাঁঠা বানানো হয় তাঁকে। আফজাল গুরুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ঘটনায় গোটা পৃথিবী ফুঁসে ওঠে। লজ্জাজনক হলেও সত্য যে খোদ ভারতের আদালতের পর্যবেক্ষণেই বলা হয়, আফজালের ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজটি ভারতের জনগণকে তুষ্টিকরণের জন্য হয়েছিল।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফজালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের প্রায় তিন মাস পর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বাল্তিস্তানের স্বাধীনতাকামী এক নেতাকে হত্যা করা হয়। রাওয়ালপিণ্ডি শহরে নিজ বাড়ির সামনে সরদার আরিফ শহিদ নামের সেই নেতাকে গুলি করে খুন করা হয়। পাকিস্তান সরকারের নজরদারি, উপত্যকাকে ঘিরে চালানো সামরিকায়নের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সরব। পাশাপাশি তিনি না ভারত, না পাকিস্তান; পরিপূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে সমগ্র কাশ্মীরকে ঐক্যবদ্ধ করতে লড়ছিলেন।
তাঁর নেতৃত্বে দুই কাশ্মীরের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘অল পার্টিজ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এপিএনএ)’। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তাঁকে দমাতে সক্রিয় হয়। আজ অবধি সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো তদন্ত হয়নি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজে প্রোথিত বিশ্বাস, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নীলনকশায় খুন করা হয় অবিভক্ত কাশ্মীরের এই জাতীয়তাবাদী নেতাকে।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের নৈসর্গিক তৃণভূমি পেহেলগামের নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ২৬ জনকে হত্যার ঘটনা সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো।
এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা এই প্রথম নয়, সম্ভবত শেষও নয়। এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহতদের প্রায় সবাই পর্যটক। দ্য ‘রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)’ পেহেলগামের ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। খুব বেশি চেনাজানা সংগঠন নয়। তবে ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, পাকিস্তানভিত্তিক ‘লস্কর-ই-তৈয়বার’ মদদপুষ্ট টিআরএফ। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায়ও লস্কর-ই-তৈয়বার সংযোগ পাওয়ার দাবি করেছিল দিল্লি। ভারত সব সময়ই অভিযোগ করে, পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশ করে এ ধরনের হামলা চালানো হয়। কাশ্মীরে এর আগে নিকট অতীতে বড় দুটি ঘটনায় অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসীদের সংযোগ থাকার দাবি করেছিল ভারত। এর মধ্যে একটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ; তখন এক বিস্ফোরণে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর কমপক্ষে ৪০ জওয়ান নিহত হন। আরেকটি হলো- ২০১৬ সালে উরি হামলা, যেখানে নিহত হন ১৬ জনের মতো জওয়ান। ঘটনাগুলোর পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্ত সীমান্ত উত্তেজনা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। পেহেলগামের ঘটনার পর নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর অনুমিতভাবে ভারত ও পাকিস্তানের নজিরবিহীন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। কূটনীতিতে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের পাশাপাশি সিন্ধু নদীর পানি এবং সিমলা চুক্তির মতো দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্য বাতিলের কথা শোনা যাচ্ছে।
পেহেলগামের ঘটনা নরেন্দ্র মোদি কিংবা শেহবাজ শরিফের নিজ নিজ স্বার্থের জিকির তোলার জন্য মোক্ষম অস্ত্র। ঘটনাক্রমে পরিকল্পিত জাতিবাদী বয়ানে জনসম্মতির নহর বয়ে যাবে শাসকের পক্ষে। বলিউডে দেশাত্মবাদী সিনেমা তৈরির হিড়িক পড়বে। হিন্দিভাষী শাসকরা দেশবন্দনার নামে ঘৃণার চাষাবাদ করবে। এর সঙ্গে ধর্মীয় উন্মাদনার ষোলোকলা যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ উন্মত্ততার প্যাকেজ তৈরি হবে। থেমে থাকবে না পাকিস্তানও। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জন্য এটি বেশ উপযুক্ত সময়। দেশের জনগণের সামনে আরো একবার তারা দেখাতে মরিয়া থাকবে, তারা আছেন বলেই পাকিস্তান টিকে রয়েছে। শেহবাজ শরিফ ও তাঁর সহযোগীরা দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার মুহূর্তটিতে সামরিক বাহিনীর পালে হাওয়া দেবেন। সম্ভবত তাদের কাজ ওটুকুই।
কিন্তু পুলওয়ামা, উরি, পেহেলগাম... বলাবাহুল্য, সামনে আরো যা যা ঘটবে; তার শেষটা জানতে উদগ্রীব মানুষ! শ্রীনগর, অনন্তবাগের তরুণদের জীবন অতিষ্ঠ করা ভারতের নজরদারি; মুজফফারাবাদ, মিরপুরে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর খবরদারিকে আড়ালে রাখতে দিল্লি-ইসলামাবাদের এসব পাল্টাপাল্টি আর খিস্তিখেউড় দেখতে দেখতে সবাই ক্লান্ত-অবসন্ন। যে তরুণী তার সদ্য অতিবাহিত ফুলশয্যার পরে পেহেলগামের মধুচন্দ্রিমা পর্ব সারতে গিয়েছিল; তার অপরাধটা কী, কেউ কি জানে? যাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে সদ্যোবিবাহিত তরুণীর স্বামী- তারা কি জানে অপরাধটা কি? এর নাম তো জনযুদ্ধ হতে পারে না। এর নাম তো জাতীয় মুক্তির লড়াই নয়। ঘটনার পরম্পরায় ভুক্তভোগী মানুষ ও তাদের সহনাগরিকদের সামনে মূর্ত হবে, মুসলমান তার শত্রু। আবার ঘটনার পূর্বাপর থেকে হামলাকারীরা ভাববে- হিন্দু কিংবা হিন্দু শাসকের রাষ্ট্র তার শত্রু। বলাবাহুল্য, ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজ নিজ দেশের সহনাগরিকদের এভাবে লড়িয়ে দেওয়ারই পক্ষে। তারা কাশ্মীরকে দেখতে চায়, ক্রুসেডপর্ব হিসেবে। পেহেলগামকে কেন্দ্র করে যুযুধান পক্ষগুলোর শেষ পরিণতি এটাই। ভুক্তভোগী সেই সাধারণ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বন্দুকধারীর হামলা