
কেমন আছেন পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতালরা
কম তো ঘুরলাম না এদেশের (ভারতের) শহর-গ্রামে। পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে এক-আধবার অন্তত যাইনি। কত চেনা-অচেনা জনপদ, নদী, সাগর, হিমালয় পর্বতমালার মন ভালো করা সৌন্দর্য, গরমের দুপুরের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের বিস্তৃত রাঢ় এলাকা। শীতের উত্তরবঙ্গ কিংবা বিপুল বর্ষার সুন্দরবন। কিন্তু আজও মনে হয়, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই আর দেখা হলো! জনজীবনের কিছুই জানা হলো না। এমন মানবজীবন, সাধারণ চাষি, জেলে, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-হতাশা কিছুই সেভাবে জানা হয়ে উঠল না। আমরা যারা খবরের কাগজে ফিচার বা কলাম লেখি, অধিকাংশই বড় বড় বিষয় নিয়ে লিখে থাকি। যুদ্ধ, দাঙ্গা, রাজনৈতিক কূটকাচালি, নেতাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ইতিহাসের সত্যাসত্য, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি-এসব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে তো লেখালেখি দরকার বটেই। কিন্তু কেন জানি না ইদানীং বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্বেষী রাজনীতির নির্মাণ হচ্ছে যখন, তখন মনে হয় আপাত তুচ্ছ ঘর-গেরস্থালির কথা লিখি, গ্রামের মুরগি লড়াইয়ের কথা বলি কিংবা স্নেহের দুই আদিবাসী ছেলেমেয়ে সাহেব আর কল্পনার কথা লিখি অথবা নদীয়ার সেই দিদির কথা শোনাই, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে খেয়া পারাপার করে বেঁচে আছেন। আপাত শান্ত সব দিনাতিপাতের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে অপার সৌন্দর্য। বিপুল সব চোখ ধাঁধানো কর্মকাণ্ডের ঢক্কা নিনাদের পাশে যেন বয়ে চলে তিরতিরে জলধারা। বহু বছর ধরে বয়ে চলেছে নদী আর মানবজীবন। আরও কত শত বছর সে বয়ে চলবে, কে তা বলতে পারে!
পশ্চিমবঙ্গের কত তল্লাটে গেছি, কিন্তু গা ছমছম করা অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলেই মনে পড়ে, বর্ষার রাতে সুন্দরবনের রায়মঙ্গল নদীতে লঞ্চে থাকার কথা। উথালপাতাল ঝড়বৃষ্টিতে লঞ্চ ডুবুডুবু। বাইরে নিকষ অন্ধকার। শনশনে হাওয়ার ডাকে অতি বড় সাহসীর বুকের রক্তও হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সারেং পরীক্ষিত বরের মুখ শুকনো, চোয়াল শক্ত। সে রাতের কথা জীবনে ভুলব না। জীবনে নদীই কি কম দেখলাম! নদীর ধারে বাস, চাষির সর্বনাশ। কোপাই, ডুলুং, মাতলা, সারি, নুনে, খুদে দ্বারকেশ্বর, দামোদর, তিস্তা, জলঢাকা, যমুনা, শিবনাথ, বিদ্যাধরী, আরও কত কত নদী। আর কবির সেই রূপনারায়ণ নদীর কথা এবার অন্তত যদি থাকে, হবে না হয় বিশদে গল্পগাথা। এখন না হয় সেই গা ছমছমে রেলস্টেশনের কথা বলি, যেখানে রাতবিরেতে পা রাখলেই শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায়। বাঁকুড়া, ছাতনা, তারপরেই আমাদের প্রিয় এ ঝাঁটিপাহাড়ি। কেউ কেউ আদর করে ডাকে ঝন্টি পাহাড়ি বলে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মধ্যখানে এ স্টেশনে খুব লোকজনের ভিড় কখনো দেখিনি। এক চাওয়ালা খদ্দের ডাকে। লাইন টপকে গেলে দু-চারটে টোটো মেলে।
এবার এসেছি সাহেব আর কল্পনার বিয়ে খেতে। যাব জামডোবাতে। স্টেশন থেকে এগারো-বারো মাইল দূরে এক ফার্ম হাউজে। সে জায়গার নামটি বেশ। সির্জন খামার। তিন-চারজন তরুণ প্রবল উদ্যমে চেনা রাস্তার বাইরে জীবনধারণের বিকল্প পথের খোঁজে এখানে ব্যস্ত। টোটো চলছে। ঘন অন্ধকার পথে। আকাশে অজস্র তারা। গাছেদের গান শুনতে শুনতে পথচলা সির্জন জামডোবা মৌজায়। ব্লক ছাতনা। আড়রা পঞ্চায়েতের মধ্যে। পঞ্চায়েত তৃণমূল কংগ্রেসের। তবে কিছু আসন এখানে সিপিআইএমের দখলে। আড়রা পঞ্চায়েতের গ্রাম সংখ্যা ৩৭-৩৮ হবে। জনসংখ্যার বিপুল অংশ আদিবাসী-সাঁওতাল। এছাড়াও বাউরি, মালো, বাগদী জনসংখ্যা কম নয়। তুলনায় উচ্চবর্গের উপস্থিতি নিতান্তই কম। লোকশ্রুতি, এখানে একদা বর্গী আক্রমণ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মুর্শিদকুলি খানের দাপটে তারা হার মানে। কাছেই পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজাদের হাতে তারা বন্দি থাকেন। পরে বশ্যতা মেনে নিলে বাংলার নবাবদের সৌজন্যে কাশীপুর রাজারা তাদের মুক্তি দিয়ে একটি তালুক তাদের উপহার দেন। সেখানে তাদের রাজা বলা হতো। এ আড়রা পঞ্চায়েত এলাকায় রাজা হচ্ছেন দেশমুখ পদবিধারী লোকজন। সে রাম ও অযোধ্যা দুই-ই আজ আর নেই। তবুও স্থানীয় আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর কাছে আজও দেশমুখেরা রাজা সাহেব। সাঁওতালদের পদবি সাধারণত বারোটি। হাঁসদা, মান্ডি, বেসরা, টুডু, মুর্মূ, হেমব্রম, বাস্কে, কিস্কু, আরও কয়েকটি। কল্পনার পদবি ‘চঁড়ে’। এ পদবি সমাজের মূল স্রোতের বাইরে। অনেকটা পিরালি ঠাকুরদের মতো।
সাঁওতালদের সমাজ আজও অনেক জায়গায় মাতৃতান্ত্রিক। মারাংবুরু প্রধান দেবতা। আদি ধর্ম সারি বা সারনা। ইদানীং অবশ্য তাদের হিন্দুত্ববাদী শক্তি নিজেদের ধর্মে টানতে সক্রিয়। তবুও যে কোনো সাঁওতাল গ্রামে গেলে তাদের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব চোখে পড়ে। কল্পনার বাড়ি উষরডিহি গ্রামে। বর আসতে আসতে গভীর রাত। বিয়ের লগ্ন আরও রাতে। মাইকে হিন্দি গান বাজছে। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা শ’ছয়েক। পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে ভোজ খেতে। খাবার মেনু চমৎকার : ভাত, পোস্ত, ডাল, মাছ, মুরগির মাংস, পাঁপড়, চাটনি, মিষ্টি। বরপক্ষ তির, ধনুক, লাঠি নিয়ে কন্যার বাড়ি ঢুকবে। কন্যার মা জামাইয়ের হাতে তুলে দেবে তির, ধনুক। এভাবেই আজও সাঁওতালদের বীরত্বগাথা রয়ে গেছে নিজেদের বিয়ের রিচ্যুয়ালের মধ্য দিয়ে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাঁওতাল সম্প্রদায়