
ট্রাম্প কি তৃতীয় মেয়াদের জন্য লড়তে পারবেন
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন, তিনি তার অপছন্দনীয় সবকিছু নিয়ে বিদ্রূপ করতে এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করতে ভালোবাসেন। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে সংবিধান তাকে যে এখতিয়ার দিয়েছে, ট্রাম্প অনেক সময় সেই এখতিয়ারের বাইরে গিয়েও কথা বলতে চেষ্টা করেন। যে কোনো রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে আসীন ব্যক্তির ক্ষমতা, গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য সম্পর্কে আমরা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকরা যেভাবে ভাবতে অভ্যস্ত, ট্রাম্প সেসবের ঊর্ধ্বে। তিনি মেপে কথা বলেন না, মনে যা আসে তা অবলীলায় বলে ফেলেন।
এই তো গত মাসেই (৩০ মার্চ) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তৃতীয় মেয়াদে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। আমেরিকান সংবিধানের ২২তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন ব্যক্তির তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি কোনো ‘কৌতুক’ করছেন না। তিনি তার যুক্তি খোলাসা করেন যে, এজন্য উপায়-পদ্ধতি আছে। তিনি তার রাজনৈতিক মিত্রদের বরাত দিয়ে বলেন, ‘বহু লোক চায় আমি এটা করি। কিন্তু আমি মনে করি এবং আমি তাদের বলেছি, এজন্য আমাদের লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। তাছাড়া প্রশাসনের সূচনাতেই কথাটা বলা আগ বাড়িয়ে বলার মতো।’
১৯৪৭ সালে কংগ্রেস সংবিধানের ২২তম সংশোধনী অনুমোদন করার পর স্টেট আইনসভাগুলোতে পাঠানো হয় সংশোধনী সমর্থনের জন্য। ১৯৫১ সালে এটি বলবৎ হয়। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদে দুবারের অধিক নির্বাচিত হতে পারবেন না, এবং যে ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদে অথবা প্রেসিডেন্ট হিসাবে অন্য কোনো ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়া পদে দুই বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য একবারের অধিক নির্বাচিত করা যাবে না।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সাক্ষাৎকারে তৃতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজে যাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করায় বিতর্ক ও কৌতূহল দুটিই সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করার পর কীভাবে তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশা করতে পারেন? এর পেছনে তো সাংবিধানিক কোনো সুযোগ বা বৈধতা নেই। তবে সম্ভবত কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসাবে অস্থায়ী ভূমিকা পালন করতে পারেন। কোন পরিস্থিতিতে সংবিধান প্রেসিডেন্ট পদে একই ব্যক্তির দুই মেয়াদের অধিক নির্বাচিত না করার বিধি সংযোজিত হয়েছিল, সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৩২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত চার মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে চতুর্থ মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্থিরীকৃত প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদে সর্বোচ্চ আট বছর দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ রাখার অলিখিত নজির অগ্রাহ্য করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্থিতিশীল নেতৃত্বের যৌক্তিকতা উল্লেখ করে অতিরিক্ত মেয়াদের জন্য তার নির্বাচিত হওয়ার ওপর জোর দিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন তার দ্বিতীয় মেয়াদের পর স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে কোনো প্রেসিডেন্ট তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রার্থী হননি, চতুর্থ মেয়াদের প্রশ্নই ওঠেনি।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অস্বাভাবিক চার মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকা নিয়ে আমেরিকান রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ছিল। তখন থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না মর্মে সংবিধান সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছিল। মূল সংবিধান প্রণেতারা বিভিন্ন প্রস্তাব বিবেচনার পর প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ চার বছর অনুমোদন করলেও কোন ব্যক্তি কতবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন, সে বিষয়ে কোনো কিছু স্থির করেননি। কিন্তু রুজভেল্টের চার মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের জের ধরেই ২২তম সংশোধনীতে কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের পর তার ওপর প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার ওপর স্থায়ীভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
আমেরিকান সংবিধানের এ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজ তথা আমেরিকার প্রভুত্ব করার আগ্রহ ব্যক্ত করা এক ধরনের চমক, যা সৃষ্টি করা তার সহজাত প্রবণতার মধ্যে পড়ে। তিনি সবসময় আলোচনায় থাকতে চান এবং তার বিরূপ সমালোচনাও তাকে বিব্রত করে না। তবে ব্যাপারটি তিনি যত সহজে বলেছেন, কাজটি করা তত সহজ নয়। এজন্য প্রয়োজন পড়বে সংবিধান সংশোধন করা এবং আমেরিকান সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। সংবিধানের এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হলে প্রথমে কংগ্রেসের উভয় কক্ষ-হাউজ বা প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের তিন-চতুর্থাংশের দ্বারা গঠিত সাংবিধানিক কনভেনশন অর্থাৎ ৩৮টি স্টেটের সমর্থন প্রয়োজন পড়বে। এরপর গৃহীত সংশোধনীর পক্ষে তিন-চতুর্থাংশ ভোটের প্রয়োজন হবে। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান দুই মেয়াদের অধিক মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও তৃতীয় মেয়াদের পক্ষে ছিলেন, তবে তার প্রস্তাবে টানা তৃতীয় মেয়াদের পরিবর্তে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদের মধ্যে বিরতির শর্ত ছিল।