গত ২০ এপ্রিল যুগান্তরে প্রকাশিত তিনটি সংবাদ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এগুলোর শিরোনাম হলো, ‘আওয়ামী লীগের ‘চেতনার দোকানে’ লুটপাট/বুদ্ধিজীবীদের এ কেমন কাণ্ড’। আরেকটির শিরোনাম, ‘বড় হচ্ছে আওয়ামী লীগের মিছিল, নেপথ্যে কারা’। তৃতীয় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে শেষ পৃষ্ঠায়। তার শিরোনাম, ‘তিন উদ্যোগে ইউনূসকে পাশে চান শি জিনপিং’। এর মধ্যে দ্বিতীয় খবরটি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মিছিল বড় হচ্ছে, এ বিষয়টি মানুষকে চিন্তিত করে। গণমাধ্যমের খবর পড়ে বোঝা যাচ্ছে, তারা ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে। ঝটিকা মিছিল বলতে বোঝায় হঠাৎ করে মিছিল বের করা এবং হঠাৎ করে তা মিলিয়ে যাওয়া। এছাড়া আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী অকস্মাৎ আদালত প্রাঙ্গণে মারমুখী হয়ে উঠেছেন। গত ২৩ এপ্রিল এবং তার আগের দিন জজ সাহেবের এজলাসে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করেছেন, ‘শেখ হাসিনার যে অভিযোগের বিচার হচ্ছে, সেই অভিযোগের চেয়ে একাত্তরের অভিযোগ গুরুতর। লাখ লাখ মানুষকে হত্যায় জামায়াত জড়িত। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ তিন হাজার সেনা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। এরশাদ সাহেবও হত্যা চালিয়েছে। তারাও গিলটি। তাদের বিচার আগে করে তারপর শেখ হাসিনার বিচার করুন।’ এর আগের দিন আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পুলিশকে এই বলে ধমকান, ‘শালা রাজাকারের বাচ্চারা, তোদের বাড় বেড়েছে। তোদের খেয়ে ফেলব।’ আদালতের এজলাসে এবং এজলাস থেকে নামার সময় স্বৈরাচারের এসব সাবেক মন্ত্রীর ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের এ বেয়াদবির কারণ হলো, প্রিজনভ্যান থেকে নামানোর পর এসব বন্দির হাতে হাতকড়া পরানো হলো কেন? শাজাহান খান বলেন, মাননীয় আদালত, আমাদের কি কোনো প্রেস্টিজ নেই? আমাদের হাতকড়া পরানো হবে কেন?
তাদের এ স্পর্ধিত প্রশ্ন শুনে বরং অনেকেই নিজেদের মধ্যে পালটা প্রশ্ন করেছেন, হাতকড়া নয় কেন? বরং জেল থেকে প্রথম দিকে তাদেরকে যখন আনা হয়, তখন এসব বন্দিকে হাত বা পা কোথাও কোনো বেড়ি পরানো হয়নি। প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ আরও দুই-তিনজন বন্দি পুলিশ বেষ্টনীর মধ্য থেকেও চিৎকার করে স্লোগান দেন, ‘জয় বাংলা’। আদালত কক্ষে এমন স্পর্ধা দেখালেও আদালত এই আদালত-অবমাননাসূচক কাজের জন্য তাদেরকে হুশিয়ার করেননি। শাজাহান খান তার মাথার হেলমেটও ছুঁড়ে ফেলেন।
অথচ বিগত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী জামানায় বিএনপি বা জামায়াতের প্রায় অধিকাংশ নেতাকেই হাতকড়া পরা অবস্থায় জেলখানা থেকে আদালতে আনা-নেওয়া করা হয়েছে। তখন বিএনপি বা জামায়াতের কোনো বন্দিকে কোনো কথা বলার সুযোগ আদালত দেয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে, আদালতের দৃশ্যমান অনুমতি ছাড়াই শাজাহান খান, ইনু, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও উচ্চকণ্ঠে আদালতকে বলছেন, ছাত্রলীগের একজন সদস্য হিসাবে আমি গর্বিত। যে সংগঠনটি নিষিদ্ধ, সেই সংগঠনের একজন নেতাকে আদালতে কথা বলানোর সুযোগ দেওয়া হয় কীভাবে?
একদিকে ভারতে থেকে শেখ হাসিনা প্রায় নিয়মিত অডিও কলে দেশ এবং বিদেশের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের কর্মীদের বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছেন, আর অন্যদিকে আওয়ামী শিবিরের লোকজন বিভিন্ন জেলায় ঝটিকা মিছিল করছে আর আদালতে জয় বাংলার আস্ফালন করছে। এ পটভূমিতে আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা নতুন করে ওঠে এসেছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না কেন? এখন তো খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, দেশের কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো পাতি নেতা ইলেকশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তারা বলছেন, আমাদের দল নিষিদ্ধ নয়, আমাদের দলের নিবন্ধনও অক্ষত আছে। এ অবস্থায় সরকার আমাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখবে কীভাবে?
২.
আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ হবে? নাকি হবে না? একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে গেলে অগ্রপশ্চাৎ কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি কোনো রাজনৈতিক দল? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আওয়ামী লীগ কি কোনো রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় পড়ে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১. জনগুরুত্বসম্পন্ন ইস্যুগুলো নিয়ে জনমত গঠন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ; ২. আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন। এই উদ্দেশ্যে সভা, সমাবেশ, মিছিল, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা; ৩. নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করার জন্য কর্মী রিক্রুট করা। অতঃপর দলের আদর্শে দীক্ষিত করে সেই কর্মীদের স্থানীয় সরকারের মেম্বার বা চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা, ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা, The term party has since come to be applied to all organized groups seeking political power, whether by democratic elections or by revolution. এই সংজ্ঞা মোতাবেক বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইউনূসের সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং যারা এটিকে অনির্বাচিত বলেন, তারা নির্বাচনের সংজ্ঞায় হয়তো সঠিক, কিন্তু Legitimacy বা বৈধতার প্রশ্নে এটি একশ ভাগ বৈধ। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোনো সংজ্ঞাতেই পড়ে না। তাই এটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এটি একটি লুটেরা ও সন্ত্রাসী দল। বিষয়টি আমি নিচে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করছি।
৩.
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গ্রেট ব্রিটেনের সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর কাছে হিটলারের জার্মানি আত্মসমর্পণ করে ১৯৪৫ সালের ৮ মে। তার মাত্র ৫ মাস পর জার্মানির নাৎসী পার্টি নিষিদ্ধ হয় ১৯৪৫ সালের ১০ অক্টোবর। সেই থেকে আজ ৮০ বছর হলো শুধু জার্মানিতে নয়, হিটলারের জন্মস্থান অস্ট্রিয়াতেও নাৎসী পার্টি নিষিদ্ধ রয়েছে। আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের রয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ ইত্যাদি অঙ্গ সংগঠন। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসী পার্টির ছিল ৫২টি অঙ্গ সংগঠন। এসব অঙ্গ সংগঠনকেও সেদিন নিষিদ্ধ করা হয় এবং আজও সেগুলো নিষিদ্ধ আছে। শুধু দল নয়, হিটলার যেরকম পোশাক পরতেন, সেই ধরনের পোশাকও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাৎসী পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পর শুরু হয় এসব দেশে DeNazification বা নাৎসী মুক্তকরণ প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নাৎসীদের বিচার। ইতিহাসবিখ্যাত Judgement at Nuremberg বা নুরেমবার্গের বিচারে নাৎসী নেতাদের সঙ্গে হিটলারের অনেক সামরিক অফিসারকেও ফাঁসি দেওয়া হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে জার্মানির মতো বাংলাদেশেও জুলাই বিপ্লবের পর শুরু হওয়া উচিত ছিল, DeAwamification বা বাংলাদেশকে আওয়ামীমুক্ত করা।