আজ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০২৫। প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়। এবারের থিম হলো
‘Malaria Ends With Us: Reinvest, Reimagine, Reignite’ । থিমটি ম্যালেরিয়া মোকাবেলায় ধারাবাহিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা, সমস্যাটির প্রতি নতুন ধারণা তৈরির গুরুত্ব এবং এই রোগ নির্মূলের প্রচেষ্টা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও চিকিত্সায় বাড়তি বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে, পাশাপাশি এটি প্রতিরোধে বর্তমান কৌশলগুলোর পুনর্বিবেচনার এবং ম্যালেরিয়ামুক্ত ভবিষ্যত্ অর্জনের নতুন প্রতিশ্রুতি তৈরি করতে চাচ্ছে। ম্যালেরিয়া একটি প্রাচীন রোগ, কিন্তু এর প্রভাব আজও ভয়বহ।
WHO -এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে ২৬৩ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এবং পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই আফ্রিকা ও এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর শিশু ও গর্ভবতী নারী। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এটি এখনো হুমকিস্বরূপ।
ম্যালেরিয়া মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বিজ্ঞানীরা ৩০ মিলিয়ন বছর পুরনো মশার ফসিলে ম্যালেরিয়া পরজীবীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। প্রাচীন মিসরের মমি পরীক্ষায়ও (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ) ম্যালেরিয়া পরজীবীর ডিএনএ শনাক্ত হয়েছে। প্রাচীন গ্রিক চিকিত্সক হিপোক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০) প্রথম ম্যালেরিয়ার লক্ষণ বর্ণনা করেন এবং ঋতুভিত্তিক জ্বরের সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক খুঁজে পান।
মধ্যযুগ থেকে ঔপনিবেশিক যুগে, ম্যালেরিয়া বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিকদের মতে, রোমান সাম্রাজ্যের পতনে ম্যালেরিয়ার ভূমিকা ছিল। ক্রুসেডাররা (১০৯৬-১২৯১) মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে ম্যালেরিয়া নিয়ে আসার পর, ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা আফ্রিকান দাসদের মাধ্যমে আমেরিকায় ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে দেয়। ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোতে ম্যালেরিয়ার কারণে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারাত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে; ১৮৮০ সালে চার্লস ল্যাভেরান প্রথম প্লাজমোডিয়াম পরজীবী শণাক্ত করেন, পরে ১৮৯৭ সালে রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়।
১৯৩০-৪০-এর দশকে ক্লোরোকুইন ও ডিডিটির আবিষ্কার ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বিপ্লব ঘটায় এবং ১৯৫৫ সালে WHO বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি শুরু করে।
তবে একবিংশ শতাব্দীতেও ম্যালেরিয়া একটি বড় হুমকিরূপে বিদ্যমান। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জনে সামগ্রিক সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলস্বরূপ, জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি কার্যকরভাবে কাজ করছে। সাফল্যের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে লং লাস্টিং ইনসেক্টিসাইড নেট (LLIN) বিতরণ, যা মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সহায়ক। দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের জন্য মাইক্রোস্কোপি এবং র্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট (RDT) ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দ্রুত চিকিত্সা শুরু করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া আর্টেমিসিনিনভিত্তিক থেরাপি
(ACT) বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, যা ম্যালেরিয়া রোগের কার্যকর চিকিত্সায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সাফল্যের পেছনে রয়েছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী (CBM) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ এবং চিকিত্সার বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল ফান্ড ও ব্র্যাকের মতো সংগঠনগুলোও বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় সরাসরি আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।