-68080ec7ae214.jpg)
ওষুধ দিয়ে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব নয়
বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৯.১ শতাংশ অর্থাৎ ৮৪ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন। অপুষ্টিতে আক্রান্ত এসব মানুষের ৮০ শতাংশ শিশু ও মহিলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। এসব দেশে প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সি প্রায় ৮৫ লাখ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। লাখ লাখ শিশু নামমাত্র বেঁচে থাকলেও উপবাসের কারণে কোনো না কোনো সময় এদের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত, অপুষ্টি প্রতিহত করা না গেলে বাড়ন্ত শিশুদের যে কোনো সময় শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপুষ্টির কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বয়োবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা ও প্রক্রিয়া গর্ভাবস্থায় শুরু হতে পারে। মা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগলে গর্ভজাত সন্তানের শারীরিক ও মানসিক গঠনে বিঘ্ন ঘটে। মানুষের মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ গঠন হয় মাতৃগর্ভে এবং জন্মের ২ বছরের মধ্যে। সেজন্য মা অপুষ্টিতে ভুগলে গর্ভজাত এবং দুগ্ধজাত সন্তানের মগজ অপরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জন্মের সময় এক-তৃতীয়াংশ শিশুর গড় ওজন আড়াই কিলোগ্রামের কম থাকে। এ কম ওজন পরবর্তীকালে শিশুর জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। এসব শিশু প্রতিনিয়তই রোগে আক্রান্ত হয় এবং স্বাভাবিক ওজনের শিশুদের তুলনায় এদের মৃত্যুর হার চারগুণ বেশি। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ কারণে এরা ঘনঘন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। রোগে ভোগে বেশিদিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সহজে এসব রোগ জটিল আকার ধারণ করে। অন্যদিকে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শিশুদের পুষ্টি বিশোষণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করে না বলে খাওয়ার পর শিশু বমি করে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা ডায়রিয়ায় ভোগে বেশি, মারাও যায় বেশি।
অপুষ্টি চরম অভিশাপ। এ অভিশাপের মূল শিকার তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। অপুষ্টির মূল কারণ প্রধানত দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণে সুষম খাদ্য গ্রহণে অক্ষম হলে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। সুস্থ-সবল জীবনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চর্বি, আমিষ, শর্করাজাতীয় খাবারসহ পর্যাপ্ত ভিটামিন, খনিজপদার্থ, বিশুদ্ধ পানি ও আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্টি হয় অপুষ্টি, অপুষ্টির কারণে নানা রোগ এবং রোগ হলেই ওষুধ কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো। দারিদ্র্য সামনে রেখে তারা ওষুধের ফাঁদ পাতে। ফর্মুলা মোতাবেক দরিদ্রদের চিকিৎসায় তারা হরেক রকম ওষুধ বাজারে ছাড়ে। অপুষ্টির সঙ্গে ওষুধের সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকার করুক আর নাইবা করুক, বিশ্বজুড়েই ওষুধ কোম্পানিগুলো উল্লিখিত ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে অপুষ্টিকে রোগ হিসাবে চিহ্নিত করে তার প্রতিকারে শত-সহস্র ওষুধ উদ্ভাবন, উৎপাদন এবং সফলভাবে বাজারজাত করে শত-সহস্র কোটি টাকা উপার্জন করে।
দারিদ্র্যের কারণে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে কোনো ওষুধ নেই। ব্যবসা, মুনাফা আর মূল্যবোধ সব সময় একে অপরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে। অপুষ্টির প্রধান উপসর্গ হলো-খাবারে অরুচি, বয়োবৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা, অপরিপূর্ণ মস্তিষ্ক গঠন, ক্লান্তি, দুর্বলতা, অবসন্নতা, বমি ও ডায়রিয়া। অসৎ মুনাফালোভী ওষুধ কোম্পানিগুলো জনগণের অজ্ঞতা আর সরলতার সুযোগ নিয়ে শঠতার মাধ্যমে প্রতিটি উপসর্গকে একেকটি রোগ হিসাবে আখ্যায়িত করে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় শত-সহস্র ওষুধ বাজারে ছাড়ে। ফলে ওষুধের বাজার ভিটামিন, টনিক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্ষুধাবৃদ্ধিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, এনজাইম, হজমিকারক, বয়োবৃদ্ধিকারক স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধে প্লাবিত হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কারণে বা খাদ্যের অভাবে সৃষ্ট অপুষ্টিজনিত সমস্যা কীভাবে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবিত ফর্মুলা দিয়ে সমাধান সম্ভব এ কথাটি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার বা নীতিনির্ধারকরা কখনোই গুরুত্বসহ ভেবে দেখেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণত ভিটামিন শরীরের বিভিন্ন মেটাবলিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে অসহায় দরিদ্র মানুষটি দিন-দিনান্তে একবেলা খাবার জোটাতে পারে না, তার শরীরে নামিদামি টনিক ভিটামিন যত পরিমাণেই প্রয়োগ করা হোক না কেন, আর্থিক ক্ষতি ছাড়া কাজের কাজ খুব বেশি কিছু হয় না। আর যারা সুষম খাবার খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন, তারা কখনো ভিটামিন-টনিক গ্রহণ করেন বলে আমার জানা নেই। যারা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় টনিক-ভিটামিন উদ্ভাবন করে বাজারে ছাড়েন এবং যেসব চিকিৎসক এসব ছাইভস্ম ব্যবস্থাপত্রে লেখেন, তারা কি কখনো এসব খেয়ে তাদের অপুষ্টি দূর করেছেন?
মানুষ বেশি হারে এবং বেশি পরিমাণে ওষুধ গ্রহণ করলে বুঝতে হবে তার রোগ বেশি। বাংলাদেশে ওষুধের বাজার বিশাল বলে আমরা গর্ব করি। তার অর্থ এই নয় কি, জাতি হিসাবে আমরা বেশি সুস্থ নই এবং সুস্থতা অর্জনের জন্য আমাদের এত বেশি ওষুধের প্রয়োজন হচ্ছে। যে দেশের মানুষ দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগানোর জন্য প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করছে, সে দেশে এত বিশাল ওষুধের বাজার কি শুধু গর্বের ব্যাপার? চিন্তার কি কোনো কারণ নেই?
শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দা কোনো রোগ নয়। এটি একটি ক্ষণস্থায়ী উপসর্গ। ক্ষুধামন্দা বা ক্ষুধাহীনতার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগের পূর্বে এর কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শিশুদের বেলায় যেসব কারণে ক্ষুধামন্দা বা খাওয়ার অনীহা সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে রয়েছে অপুষ্টি, সংক্রামক রোগ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, খাদ্য বিশোষণে বিঘ্ন ঘটা, হৃদরোগ, রেনাল ফেলিউর, প্রদাহ, জেনেটিক ডিসঅর্ডার, ক্যানসার ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে যতই ক্ষুধা উদ্দীপক প্রয়োগ করা হোক না কেন, ফল হবে মূলত শূন্য।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অপুষ্টিজনিত রোগ