
দাঙ্গার প্ল্যানিং: কিছু জানা আর কিছু না জানা কথা
কতগুলো বস্তাপচা কথাবার্তা অনেকেই বারবার করে বলে বলে এক মিথ্যার বিনির্মাণ করেন বা মিথ্যাকে গড়ে তোলেন। এমন বহু মিথ্যা মিথ আছে, যা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি বা বড় হয়ে শুনেছি। এ মিথ্যার নির্মাণ চলতেই থাকে। তেমন একটা মিথ্যা হলো ‘সরকার না চাইলে, প্রশাসন না চাইলে, দাঙ্গা হয় না।’ কথাটি বিশেষ করে এক অংশে বামপন্থিরা প্রায়ই বারবার করে ব্যবহার করে থাকেন।
এক সময় রাষ্ট্রের তেমন কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করার জন্য দুই সম্প্রদায়ের ইন্ধন লাগত। আর রাষ্ট্রের এক নীরবতা তাকে ছড়াতে সাহায্য করত। ব্রিটিশ শাসনে এমনটি ঘটেছে বারবার। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে এবং আমাদের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সময়ে রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। তার পুলিশ, তার মিলিটারি সব মিলিয়ে তার নিয়ন্ত্রণের পরিধি বেড়েছে। কাজেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামাতে রাষ্ট্রের এক প্রত্যক্ষ ভূমিকা আমরা দেখেছি। কী ডান, কী বাম, কী মধ্য-যে কোনো শাসনে এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে, যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। আমরা গুজরাটেও সেই ঘটনা দেখেছি। রাষ্ট্র সেখানে সরাসরি এক ধরনের ভূমিকা নিয়েছে। অর্থাৎ সে সময় এ কথাটি সত্য ছিল-রাষ্ট্রের ভূমিকা ছাড়া, রাষ্ট্রের ইচ্ছা ছাড়া, প্রশাসনের ইচ্ছা ছাড়া দাঙ্গা হবে না। কিন্তু তারও পর এ জমানা এলো, যেখানে দাঙ্গা করার জন্য হাজার পাঁচ-ছয় ফেইক সোশ্যাল মিডিয়া-ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। জনা পঞ্চাশেকের একটা ফিল্ড তৈরি করতে হবে, যারা ফিল্ডে কাজ করবে, আর মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার পূর্ণ সমর্থন থাকতে হবে। দাঙ্গা শুরু করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। রাষ্ট্র চাক বা না চাক, এখন দাঙ্গা বাধানো যায়।
পৃথিবীজুড়ে এই যে ছবিটা, এ ছবিটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। কোনো সংগঠন নেই অথচ মানুষ জড়ো হয়ে যাচ্ছেন, মানুষ একটা মুভমেন্ট করে ফেলছেন। মানুষ একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলছেন। কিছু মানুষ, কিছু ফেইক নিউজ ছড়াচ্ছেন এবং একটা দাঙ্গা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেই দাঙ্গা কতক্ষণ চলবে, কতদিন চলবে, সেটার সঙ্গে নিশ্চয়ই জড়িয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্রের ভূমিকা। কিন্তু দাঙ্গা শুরু করানোর জন্য, দাঙ্গা লাগানোর জন্য রাষ্ট্রেরই প্রয়োজন লাগবে, প্রশাসনেরই প্রয়োজন লাগবে, এ সত্যিটা আজকে মিথ্যা হয়ে গেছে। এটি আর আজকে সত্যি নয়। প্রশাসন ও সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াও এখন দাঙ্গা বাধানো সম্ভব। সারা দেশে আমরা তার ছোট ছোট জায়গা দেখতে পাচ্ছি। শুধু তাই নয়, আমাদের এ বাংলায় গত বেশকিছু দাঙ্গার যদি কিছু কেইস হিস্ট্রিকে অ্যানালাইসিস করা যায়, তাহলে সেটা তা-ই বলছে। আজ নয়, দাঙ্গার এ সহজ ফর্মুলা ২০১৪-১৫ থেকে শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মাধ্যম যখন থেকে খুব তীব্রভাবে মানুষের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে, মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে, তখন থেকেই সেটা শুরু হয়ে গেছে। খুব সাধারণ মানুষও হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ থেকে, ফেসবুক থেকে ইনস্টাগ্রামে চোখ দিচ্ছেন এবং ঠিক সেই সময় থেকে আমরা শুনেছি বিজেপি আইটি সেলের কথা। সেই দানবের পুরো চেহারাটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা উদাহরণ দেই, ২০১৯-এর ঘটনা। মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে স্বামী-স্ত্রী আর তাদের শিশুসন্তানকে পাওয়া গেল রক্তমাখা অবস্থায়। রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো। ঘটনা যেদিন ঘটেছে, সেদিনই বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেটার এবং বিজেপির একজন সংসদ-সদস্য গৌতম গম্ভীর দিল্লি থেকে টুইট করলেন, আরএসএসের সঙ্গে এ মৃতদের যে সম্পর্ক রয়েছে, সেই সম্পর্ক যেন তদন্তে কোথাও বাধা না পায়। অর্থাৎ তিনি জানিয়ে দিলেন, এ হত্যাকাণ্ডে আরএসএসের দুজনকে মারা হয়েছে। মানে একটা আরএসএস অ্যাঙ্গেল এ হত্যায় এসে গেল। এর পরের টুইট অর্জুন সিংয়ের; তিনি হিন্দিতে টুইট করেন, যার অর্থ দাঁড়ায় একটি শিশুসমেত তিনজন খুন হয়েছে, তারা আরএসএসের সদস্য, তাদের মারা হয়েছে। রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজ্যের প্রশাসন তাকে সাহায্য করছে। অর্জুন সিং এ ঘটনার এভাবেই প্রতিবাদ করেছেন। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা ছড়াল, গর্ভবতী স্ত্রী ও সন্তানসহ আরএসএস কর্মকর্তাকে মারা হয়েছে। তারা মুসলিম মেজরিটি এলাকায় থাকত বলে মুসলিমরাই তাদের মেরেছে। প্রচার হলো, কেবল হিন্দুদের মারা হচ্ছে। সেই রক্তমাখা ছবিসহ বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রত্যেক মাধ্যমে ছড়াতে থাকল। ভারতের প্রখ্যাত খেলোয়াড় গৌতম গম্ভীর থেকে শুরু করে অর্জুন সিংয়ের মতো লোকরা যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে টুইট করছেন এবং লিখছেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই একেবারে নিচু লেভেল থেকে সর্বত্র এটি ছড়িয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এর প্রতিক্রিয়া বেরোচ্ছে। এবারে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া নেমে পড়েছে। বিজেপি চিৎকার করছে ‘হিন্দু খাতরেমে হ্যায়।’ রবিশঙ্কর প্রসাদ ততক্ষণে টার্গেট করেছেন লিবারেলদের।
এতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছিল, এবার লিবারেলদেরও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। অর্থাৎ হে লিবারেলরা, হে উদার মানসিকতার লোকজনরা, আপনারা এ ঘটনার প্রতিবাদ করুন। আপনারা চোখ বুজে আছেন কেন, চুপ করে আছেন কেন? আরএসএস মারা গেছে বলে আপনারা চুপ করে আছেন। এতগুলো কথা রবিশঙ্কর প্রসাদ, যিনি এত বড় নেতা-মন্ত্রী, তিনি যখন বলছেন, এমপিরা যখন বলছেন, তখন বাকিরা চুপ করে থাকবে কেন। অতএব মিডিয়ার কুত্তারা মাঠে নামল। টাইম্স নাউ টুইট করেছে, ৪৯ জন বিভিন্ন স্তরের মানুষজন এ সেফরন টেরোরের বিরোধিতা করেছে, আপনারা চুপ করে আছেন কেন। আমার কথা হচ্ছে, এভাবে আপনারা কি খবর দেখাচ্ছেন, না জনমত গঠন করছেন? এসবই চলছে দেশে (ভারতে)।
ঘটনা ঘটেছে ৯ তারিখ রাতে, ১০, ১১, ১২ তারিখ অতিবাহিত হয়ে গেছে। ১৩ তারিখে কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে, জিয়াগঞ্জে যারা মারা গেছে, সেটা দুঃখজনক ঘটনা। ঘটনার পরেই তদন্ত শুরু হয়েছে। দুজনকে ধরা হয়েছে এবং তাদের জেরা চলছে। কোনো একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করতেন মারা যাওয়া ভদ্রলোক। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারাও এই ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে জড়িত। মৃত ব্যক্তির পরিবারটি একটা সাংঘাতিক অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে ছিলেন এবং তাদের পরিবার থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হলো, তারা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে কখনো ছিলেন না। আরএসএস তো অনেক দূরের কথা। পরিবারের মধ্যে ডায়েরি ও বিভিন্ন জিনিস নিয়ে তর্কাতর্কি চলছিল, অশান্তি চলছিল। সিআইডিকে ডেকে আনা হয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত করছেন। ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং ঝগড়ার ফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্য হিন্দু রিপোর্ট করল, ‘খুন হওয়া ব্যক্তি প্রকাশ পাল ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। যাদের ধরা হয়েছে, তারা পালের কাছ থেকে দুটি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনেছিল। এর মধ্যে প্রথমটার রিসিট তাদের পাল দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রিসিট তিনি দিতে চাইছিলেন না কিছুতেই। এ তর্কাতর্কির পরেই প্রকাশ পাল খুন হয়েছিল। এটা একটা অপরাধমূলক ঘটনা, এটার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’ এটাই হচ্ছে সেই মিথ্যার মূল ঘটনা। অর্থাৎ ভাবুন, একটা খুন হলো ব্যক্তিগত ক্রোধকে কেন্দ্র করে। কিন্তু যেদিন খুন হলো, সেদিন থেকে গৌতম গম্ভীরের মতো সংসদ-সদস্য, কৈলাস বিজয়বর্গীর মতো বিজেপি নেতা, অর্জুন সিংয়ের মতো সংসদ-সদস্য, রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো মন্ত্রী টুইট করে জানালেন, আরএসএস কর্মী খুন হয়েছে। সর্বত্রই এসব খবর যাচ্ছে, দেখো দেখো হিন্দুদের কেমন করে খুন করা হচ্ছে। হ্যাঁ, সেদিন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল বলে, প্রশাসন দাঁড়িয়েছিল বলে কোনো ধরনের দাঙ্গা হয়নি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা