
রাজনৈতিক দল সংস্কার একবারে হয় না
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পরিবারতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক রাজনীতিতে আটকে আছে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ একেবারে হঠাৎ করে পুরোনো কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারবে না। আমাদের সংস্কারগুলো যদি দেশের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে কৌশলগতভাবে পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পন্ন করা যায়, তাহলে তা টেকসই হবে।
রাতারাতি পরিবর্তনের ধারণা
জনগণের আশা, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে দ্রুত সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক, মেধাভিত্তিক দলকাঠামোতে রূপান্তরিত হবে। আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতাব্যবস্থার শিকড় অনেক গভীরে। আইনের শাসন এখানে দুর্বল। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য প্রবল।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐতিহাসিক বিকাশ দেখলে বোঝা যায় যে সেখানে সংস্কার কীভাবে ধাপে ধাপে ঘটেছে। অর্থবহ দলকাঠামো গড়তে তাদের প্রায় এক শতাব্দী লেগেছে। আর উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ সংস্কার বাস্তবায়নে লেগেছে আরও এক শতাব্দী।
প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগেই আমূল পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা অগ্রগতির বদলে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। ফলে আমাদের ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোর মতো ধীরে ধীরে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ শাসনের দিকেই যেতে হবে।
অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি শক্তিশালী করা
এই ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় না গিয়ে বিদ্যমান দলকাঠামোর মধ্যে আবশ্যকীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর একসময়ের কর্তৃত্ববাদী শাসক দল ‘গোলকার’ আঞ্চলিক চেয়ারম্যানদের জন্য মেয়াদসীমা চালু ও অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করে। পরিবারতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলো প্রভাবশালী থাকলেও এসব সংস্কার তরুণ উপযুক্তদের মূল পদগুলোতে যেতে সহায়তা করেছে।
ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টি ছিল অভিজাতদের এক ক্লাব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তারা ধাপে ধাপে আরও গণতান্ত্রিক সংগঠন হয়ে ওঠে। প্রথমে ১৮৩০-এর দশকে স্থানীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা, এরপর ১৮৬০-এর দশকে আনুষ্ঠানিক সদস্যকাঠামো চালু করে তারা। এভাবে বিংশ শতাব্দীতে আরও উন্মুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনপ্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশে জেলা সভাপতির মতো মধ্যবর্তী স্তরের নেতাদের জন্য মেয়াদসীমা আরোপ এবং শীর্ষ পদগুলোর জন্য নির্বাচকমণ্ডলী সম্প্রসারণ করা হলে পর্যায়ক্রমে পরিবারতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কমে আসবে।
আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ
অস্বচ্ছ অর্থায়ন নিয়ে হঠাৎ করে কঠোর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিলে দলীয় কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। ১৯৯০-এর দশকে ব্রাজিলে আংশিক সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সীমার ওপর অনুদান জনসমক্ষে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। পাকিস্তানের ২০১৭ সালের নির্বাচন আইন প্রার্থীদের আর্থিক আয় ও ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে আর্থিক হিসাব প্রকাশের বিধান বাস্তবায়ন এখনো অসম্পূর্ণ।
ধারাবাহিক আর্থিক নিয়ন্ত্রণের একটি ঐতিহাসিক নমুনা হলো যুক্তরাষ্ট্র। ১৯০৭ সালের টিলম্যান অ্যাক্ট দ্বারা করপোরেট দান নিষিদ্ধ, ১৯২৫ সালের ফেডারেল করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট দ্বারা অনুদান বিষয়ে তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৭১ সালের ফেডারেল ইলেকশন ক্যাম্পেইন অ্যাক্টের মাধ্যমে আরও ব্যাপক সংস্কার করা হয়। তারপরও সেখানে অর্থ নির্বাচনকে প্রভাবিত করেই চলছে।
বাংলাদেশে প্রথমে ১০ লাখ টাকার ওপর দানসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা যায়। এরপর ধীরে ধীরে কঠোর অডিট এবং শেষে দলগুলোর জন্য সরকারি অর্থায়নের দিকে যাওয়া যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জার্মানি এ ধরনের ধারাবাহিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক দল
- সংস্কার কাজ