
মানবজীবনের নিদারুণ অপচয়
গতকাল রিকশা করে যাচ্ছিলাম। যানজটের মধ্যে উত্তপ্ত এক প্যাডেলচালিত রিকশাওয়ালা একজন ব্যাটারি রিকশাচালককে ঝগড়ার ফাঁকে বলে বসলেন, ‘তোদের মতো রোহিঙ্গাদের কারণে শহরটার এই অবস্থা।’ যিনি ধমক খেলেন, তিনিও কম যান না, নিজ শ্রেণির অপরজনের প্রতি শ্লেষ আর বিদ্বেষের সুরে বলে উঠলেন, “তুই চুপ থাকা ‘কালা বান্দর’।’’ বলা বাহুল্য, প্রথম ব্যক্তিটির ত্বকের রঙ প্রথমজনের তুলনায় কিছুটা কালো যে ধরনের মানুষের বিবরণ দিতে অনেকেই বলে থাকেন, উনার গায়ের রঙ ময়লা। কৃষ্ণকলি কিংবা প্রেমিকার গায়ের কালো রঙ নিয়ে অনেক কবিতা, গান হলেও পলিটিক্যাল কারেক্টন্যাসের বাইরের সমাজে বর্ণবাদ কখনো কখনো অতি স্থূল হয়ে ধরা দেয়। হাজার মাইল দূরের কালো মানুষদের এক দেশের গল্পে যাই।
দুই বছর আগে রমজান মাসে সুদানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। গত বছরের নভেম্বর নাগাদ শুধু রাজধানী খার্তুমেই প্রাণ হারায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। এ বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং ৩৫ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালায়। আফ্রিকার এই দেশটির শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই মুসলমান এবং গৃহযুদ্ধে বিবদমান দুটি দলের অধিকাংশই মুসলমান। চলতি সপ্তাহে এই যুদ্ধের দুই বছর পূর্তি হলো। এর ক্ষয়ক্ষতি ও হিংসা বেড়েই চলছে। তবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে তেমন সাড়াশব্দ নেই। যদিও সপ্তাহখানেক আগেই, দখলদার ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে গণহত্যার প্রতিবাদে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সন্দেহ নেই, ইসরায়লের এই গণহত্যা চলতি শতাব্দীতে সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ। কেবল মুসলমানেরাই নয়, গোটা দুনিয়া এই ভয়ংকর অপরাধের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। ইসরায়লের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, যাদের ক্ষমতার জোরে এই হত্যাকাণ্ড চলছে, সেই মার্কিন মুলুকেও চলছে প্রতিবাদ।
ইউরোপ জুড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করছে। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ থামছেই না। আমাদের শত প্রতিবাদেও ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবন রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রতি রাতে বিশ্ব মানবতাকে এই অপরাধবোধ নিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। কিন্তু সুদানের মানুষদের জন্য সেই সান্ত্বনাটাও যেন নেই। একে তো গৃহযুদ্ধ, দ্বিতীয়ত আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ, যেই মহাদেশ ঐতিহাসিকভাবে চরম নিপীড়ন এবং জঘন্যরকম বর্ণবাদের শিকার। কালো মানুষদের শতাব্দীর পর শতাব্দী দাস বানিয়ে রাখা ইউরোপীয়রা তো বটেই, এমনকি আমাদের মতো বাদামি চামড়ার মানুষেরাও, যারা দীর্ঘদিন নিজেরাই ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ছিলাম, তারাও যেন অনেকটা উদাসীন। এর একটা কারণ হতে পারে আমাদের সঙ্গে মহাদেশটির ভৌগোলিক দূরত্ব। আরেকটা কারণ হতে পারে বিশ্ব মিডিয়ায় তুলনামূলক কম আলোচনা এবং অস্বস্তিকর শোনালেও, এর পেছনে হয়তো কাজ করতে পারে আমাদের বর্ণবাদ।