
জায়নবাদ ও নাৎসিবাদ পরস্পরের সম্পূরক
নির্যাতনের সংস্কৃতি সবচেয়ে আত্মস্থ করে নির্যাতিতরাই। নির্যাতক এই কুসংস্কৃতি বিসর্জন দিতে পারলেও নির্যাতিত তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে, যেন এই কুসংস্কৃতি ছাড়া তার অস্তিত্বই বিপন্ন। অতএব নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভের পর সবচেয়ে বড় বিপদ নির্যাতিতের নিজেরই আরও ভয়ঙ্কর নির্যাতক হয়ে ওঠা। এরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের চলমান গণহত্যায়। অথচ এই ইহুদিরা একদা ছিল পৃথিবীর একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠি, যাদেরকে শত শত বছর দেশ থেকে দেশান্তরে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠির হাতে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে তাদেরকে ভয়ঙ্কর এক গণহত্যার শিকার হতে হয়, যা হলোকাস্ট বলে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তাদের জন্য একটা কৃত্রিম রাষ্ট্র তৈরি করা হয় যার নাম ইসরায়েল। আর সেই ইসরায়েলের শাসকরা আজ পশ্চিমা খ্রিস্টান শক্তির মদদে গাজায় পরিচালনা করছে আরেক গণহত্যা যা হলোকস্টের পুনরাবৃত্তিস্বরূপ, আর এবার তা প্রকাশ্যে।
এই গণহত্যার খলনায়ক ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল, তবে নাটের গুরু গোঁড়া খ্রিস্টান এবং তাদের মিত্র ব্রিটিশ-মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি। উনবিংশ শতাব্দীতে ইহুদিবিদ্বেষী খ্রিস্টানদের একাংশ ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে থাকে। কেননা বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তখন সেখানে যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান ঘটবে ও সকলেই খ্রিস্টান হয়ে প্রতিষ্ঠা করবে খ্রিস্টরাজ্য। অন্যদিকে তারা নিজ দেশে ইহুদিদের উপস্থিতি আর চাচ্ছিল না, তাই তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে বিতাড়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯১৭ সালে যে বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনকে বেছে নেয়। এই ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে আর্থার বেলফোর উদ্যোগী হয়েছিলেন, তিনি নিজেই এক ইহুদি-বিদ্বেষী। ১৯০৫ সালের এলিয়েন্স অ্যাক্ট পাশ হয় যখন তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী– যার উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে ইহুদিদের আগমন বন্ধ করা। এই বেলফোর ঘোষণা যেমন ইহুদি বিদ্বেষ থেকে তেমনি এটি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথগামী ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষ দুর্গ নির্মাণের চেষ্টা।
নূর মাসালহা ফিলিস্তিন ইতিহাসের চার হাজার বছর নিয়ে লেখা বইতে লিখেছেন, “জায়নবাদী দখলদারি ঔপনিবেশিকতার শেকড় ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদের গভীরে নিহিত।’ যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যেত না, সেখানে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে আর দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তরকালে তা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার পথে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সেখানে ইউরোপিয়ানদের দখলদারি উপনিবেশের নতুন প্রকল্প হিসেবে হাজির হয়।”
ইহুদি-বিদ্বেষী খ্রিস্টানদের তৈরি এই জায়নবাদ দ্রুত ইহুদিদের একাংশের রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত হয়। ইতিহাসের এক মর্মান্তিক পরিহাস এই যে, ইহুদি-বিদ্বেষী ও ইহুদি-প্রেমী দুইই দাঁড়ায় এক জায়নবাদের ছাতার নিচে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের যাত্রাই শুরু হয় গণহত্যার মধ্য দিয়ে। বিশ্বখ্যাত ইহুদি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে তার ‘দ্য এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ১৯৪৮ সালের মার্চে “সিদ্ধান্ত গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে এই মিশন সম্পূর্ণ করা হয়। যখন এটা শেষ হয়, ফিলিস্তিনের অর্ধেক জনসংখ্যা, অর্থাৎ প্রায় ৮,০০,০০০ মানুষ উচ্ছেদ হয়, ৫৩১টি গ্রাম ধ্বংস করা হয় এবং ১১টি নগর খালি হয়ে যায়।” তিনি লিখেছেন যে, হলোকাস্টের পর মানবতা-বিরোধী বৃহৎ অপরাধী কর্মকাণ্ড লুকানো প্রায় অসম্ভব হয়েছে অধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে। “এবং তারপরও এরকম একটি অপরাধ বৈশ্বিক জনস্মৃতি থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে: ১৯৪৮-এ ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ।”
সে সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ইহুদি এবং সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানি আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৪৬-এ হেনরি জে. ফ্যাক্টরকে এক চিঠিতে লেখেন যে, তিনি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটি বাসভূমি করার পক্ষে, কিন্তু কোনো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নয়। তিনি লিখেছিলেন, “আমার কাছে এটা একটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে, ফিলিস্তিনে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই ইহুদি নয়, তাদের ওপর আমরা রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা চাইতে পারি না।” ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন যখন আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আমন্ত্রণ জানান, তখনও তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। জায়নবাদের আদর্শিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণহত্যা
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
- শহর দখল