
জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন যে কারণে প্রয়োজন
বাংলাদেশে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার একটা বড় দুর্বলতা হলো এখানে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিদ্যমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যে একচেটিয়া ক্ষমতা রয়েছে, তার ফলে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এমনকি সাংবিধানিক সংস্থাগুলোও তার বাইরে থাকতে পারে না।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে সব সময় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের সব অঙ্গের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সমন্বিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রয়োজন। এ লক্ষে৵ই সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী এনসিসি গঠিত হবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল থেকে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং তৃতীয় একটি (সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে) দল থেকে একজন সংসদ সদস্য নিয়ে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও এই সুপারিশ করেছে।
সুপারিশ অনুযায়ী, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ হবে এনসিসির সুপারিশের ভিত্তিতে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের একক কর্তৃত্বে এখন যেভাবে নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদি পদে নিয়োগ হয়, তা আর সম্ভব হবে না। সরকারি দল, বিরোধী দলসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নিয়োগ করা হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এক ব্যক্তি বা এক দলের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
আইনসভা ভেঙে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন। এ সময় এনসিসির সদস্য থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, বিচারপতি ও প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুজন সদস্য। ফলে যেকোনো ধরনের জাতীয় ও রাজনৈতিক সংকটের সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এনসিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মতো এই সাংবিধানিক কমিশন বা এনসিসি গঠনেরও বিরোধিতা করেছে। বিএনপি মনে করে, এসব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই থাকা উচিত, যথাযথ আইন করেই নাকি এসব নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এর জন্য এনসিসির প্রয়োজন নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, নির্বাহী, আইন ও বিচার—এই তিন বিভাগের বিষয়ে এবং কিছু কমিশন, বিশেষ করে সাংবিধানিক কাউন্সিল করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের যেসব এখতিয়ার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন একটা ভূমিকা থাকবে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে, এটা হচ্ছে সংবিধানের মূল চেতনা। সাংবিধানিক কাউন্সিল করা হলে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অথচ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এনসিসির যে ৯ সদস্যের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি ছাড়া আর সবাই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাহলে এনসিসিকে কীভাবে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত বলা যায় তা বোধগম্য নয়।
এনসিসির নয়জন সদস্যের মধ্যে সরাসরি সরকারি দলের প্রতিনিধি হলেন প্রধানমন্ত্রী, উচ্চকক্ষের স্পিকার ও নিম্নকক্ষের স্পিকার। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকেও সরকারি দল ঘনিষ্ঠ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রধান বিরোধী দল থেকে থাকবেন বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার। প্রধান বিরোধী দলের বাইরে আরেকজন বিরোধী সংসদ সদস্য এর সদস্য থাকবেন। এর বাইরে এনসিসি সদস্য থাকবেন প্রধান বিচারপতি।