
‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ দুই বছর আগে স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধির করা একটি প্রতিবেদনের অংশ এটি। এই প্রতিবেদনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদন ও ফটোকার্ডের কারণে যে দমন–পীড়ন নেমে এসেছিল, তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জনমনে। প্রকৃতপক্ষে কোভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ আমলে চূড়ায় ওঠা চোরতন্ত্রী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে যে লুটপাট (১৫ বছরে ২৮ বিলিয়ন ডলার), তার ফলে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট, তার কারণে বিপুল জনগোষ্ঠী জীবনযাপনের যে ত্রাহি মধুসূদন দশা, তাতে ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ বাক্যটি মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল।
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া রিকশাচালক, দোকানদার, হকার, মুটে, সিএনজিচালক, ছোট বেতনের চাকরিজীবীরা নেমে এসেছিলেন বলেই হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছিল। আট মাসে আগের সেই ব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে যাবে, সেটা আশা করা ভুল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে—এমন উদ্যোগ কোথায়? বরং অভ্যুত্থানের পর অনেক ক্ষেত্রেই গরিব মানুষেরা যেন বাদ পড়া মানুষ হয়ে পড়েছেন।
অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনযাপনের সংকট তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরা অন্য কোনো দেশের মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ ভাত খান। এর পরিষ্কার হিসাব হলো, পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। এক বছর আগের তুলনায় চালের দাম মানভেদে কেজিতে বেড়েছে ১১–১৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গরিবের মোটা চাল। চালের দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বাড়লে মাস শেষে একটি সংসারে শুধু চালের পেছনে খরচ কতটা বাড়ে?
এ লেখায় ২৬ মার্চের সেই প্রতিবেদন উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, ঈদের আগে দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবিতে করা আন্দোলনে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আমাদের মাছ, মাংস, চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের তৈরি পোশাকশিল্পে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত শ্রমিকদের কেন তাঁদের পাওনার জন্য আন্দোলন করতে হয়?
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংকট, সেটাকে উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। এখানে সম্পদ সমাজের ওপরের তলার কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে। সম্পদ পঞ্জিভবনের এই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্র, সরকার সর্বজনের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়। আর আলাদিনের চেরাগ পাওয়া গোষ্ঠীটি তাদের সম্পদ পাচার করে দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চরমতম আয়বৈষম্যের দেশে দ্রুতগতির কোটিপতি উৎপাদন থেমে নেই। সাত মাসে কোটিপতি বেড়েছে ৫ হাজার।