
ভারতে ওয়াক্ফ বিল: হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলের নবতম অধ্যায়
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং একবার বলেছিলেন, অধিকাংশ প্রদেশেই মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হিন্দুরা। মুসলমানদের মধ্য থেকে কেন বড় মাপের নেতা উঠে আসছেন না, তা ভেবে দেখা দরকার। উত্তর প্রদেশের উদাহরণ দিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, এই রাজ্যের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা এখন মুলায়ম সিং যাদব। হেমবতীনন্দন বহুগুণা ও বীরবাহাদুর সিংকেও মুসলমানরা আঁকড়ে ধরেছিলেন। কারণ, তাঁরা দাঙ্গা হতে দিতেন না।
এখন দাবি, নরেন্দ্র মোদিই মুসলমান সমাজের সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। মুসলমানদের ভালোমন্দের ‘দায় ও দায়িত্ব’ নাকি তাঁরই। গাঁক গাঁক করে সেই প্রচার চলছে। নিরন্তর। যেমন তিন তালাক নিষিদ্ধ করে মোদিই মুসলমান নারীর মুক্তি ও কল্যাণের দরজা খুলে দিয়েছেন! পশ্চাৎপদ ‘পসমন্দা’ মুসলমানদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করছেন! ওয়াক্ফ আইনও সংশোধন করা হয়েছে গরিব ও সাধারণ মুসলমানদের হিতে! ওয়াক্ফর অধীন বিপুল ভূসম্পত্তি ঠিকভাবে কাজে লাগালে বছরে কম করে হলেও ১২ হাজার কোটি রুপি আদায় হবে, যা গরিব মুসলমানদের কল্যাণে খরচ হতে পারে। ২০ বছর আগে সাচার কমিটির রিপোর্ট এই হিসাব দিয়েছিল। সরকারের দাবি, ওই টাকায় মুসলমানদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা একমাত্র মোদিই ভাবলেন।
অর্থাৎ মোদিই ভারতীয় মুসলমানদের মসিহা। সংসদের দুই কক্ষে ওয়াক্ফ বিল পাস করার সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে এই ন্যারেটিভই খাড়া করা হয়েছে।
অথচ দেশের মুসলমান সমাজ ও বিরোধী মহল এই সরকারি তত্ত্ব বিলকুল খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র যুক্তিতে চলে না। চলে গরিষ্ঠের মতে। শাসককুল সেই জোরেই সংসদে বিল-বৈতরণি পেরিয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা বহুবিভক্ত বিরোধীদের জোটবদ্ধ করে দিয়েছে। ছন্নছাড়া ‘ইন্ডিয়া’ জোট পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে ওয়াক্ফ বিলকে কেন্দ্র করে। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কত দিন জোটবদ্ধ থাকবে, তা অবশ্য পরের কথা।
জোটবদ্ধতার ছবি বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময় যেমন ছিল, বিল পাস হওয়ার পরও তেমনই রয়েছে। একে একে সবাই দ্বারস্থ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের। কংগ্রেসের মহম্মদ জাভেদ ও এআইএমআইএমের আসাউদ্দিন ওয়েইসি আলাদাভাবে মামলা করেছেন। দুজনেই বিল নিয়ে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) সদস্য ছিলেন। মামলা করেছেন আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা আমানুল্লা খানও। মামলা আরও হবে; যদিও কবে এই বিতর্কের আইনি অবসান ঘটবে, বিচারপতিরাই তা জানেন।
এতকাল ওয়াক্ফ-সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ছিল মুসলমান সমাজ। সেই অধিকারে ভাগ বসানোর কাজটা নতুন আইন করে দিয়েছে স্রেফ গরিষ্ঠতার জোরে। তা করতে গিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছে মুসলমানদের জন্য সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এই দাবি বিল নিয়ে আলোচনার সময় জেপিসিতেও বিরোধীরা তুলেছিলেন। কিন্তু যে কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপির, ৩১ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জন শাসক দলের, সেখানে বিরোধী মত গুরুত্ব পাবে, তা-ও এই জমানায়, ভাবাই বাতুলতা। বিরোধীরা বিলে ৪৪টি সংশোধনী জমা দিয়েছিলেন। একটাও গ্রাহ্য হয়নি। সরকারপক্ষ থেকে জমা পড়েছিল ২৬টি। ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হয় এবং দুই কক্ষে বিলটি পাস হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সাম্প্রদায়িকতা
- আইন পাস