
ট্রাম্পের শুল্কনীতির খাঁড়ায় বাংলাদেশ
বিশ্ববাণিজ্যের বাস্তবতা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমদানি ও রপ্তানির ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বা কর আরোপ করে থাকে। তবে এই শুল্কনীতির প্রভাব শুধু রাজস্ব আদায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, শিল্প খাত, ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং জনগণের জীবনমানেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই বাস্তবতা আরও জটিল ও চ্যালেঞ্জিং।
ধরা যাক, আপনি বাংলাদেশে একটি জাপানি মোটরসাইকেল আমদানি করতে চান। ধরুন, জাপানে সেই মোটরসাইকেলের দাম ২ লাখ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যদি এই ধরনের পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক ধার্য করে, তাহলে সেই মোটরসাইকেলের মূল্য হয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, কাস্টমস ফি, ব্যবসায়ীর মুনাফা ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে বাজারে তার দাম গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৭-৮ লাখ টাকায়। অথচ, ভারত বা নেপালে একই মোটরসাইকেল হয়তো বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩ বা ৪ লাখ টাকায়, কারণ সেখানে আমদানি শুল্ক কম এবং বাজার প্রতিযোগিতা বেশি।
এই ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশে ক্রেতাদের একটি বড় অংশের পক্ষে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য কেনা কঠিন হয়ে পড়ে। যেসব মানুষ নিরাপদ ও টেকসই পরিবহনের জন্য একটি ভালো মোটরসাইকেল কিনতে চায়, তাদের জন্য এই উচ্চমূল্য নিরুৎসাহজনক। অনেক সময় তারা স্থানীয় নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হয় বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর ফলে শুধু ভোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বরং নিরাপত্তা, জ্বালানি দক্ষতা এবং পরিবেশদূষণের দিক দিয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এই একই নীতির প্রভাব আমরা দেখতে পাই রপ্তানি ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলো তৈরি পোশাকশিল্প, যা দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই পণ্যের প্রধান বাজার। সম্প্রতি ট্রাম্প বাংলাদেশি পোশাকের ওপর পাল্টা ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেন। আগে থেকেই ১৫.৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছিল। এর ফলে জারা, এইচঅ্যান্ডএম কিংবা জিএপির মতো ব্র্যান্ডগুলো তাদের খরচের হিসাব নতুন করে করতে বাধ্য হচ্ছে। যেখানে আগে ৩০ ডলারে বিক্রি হওয়া একটি শার্ট এখন ৪৪ ডলারে বিক্রি করতে হচ্ছে, সেখানে অনেক ক্রেতা সেই বাড়তি দাম দিতে আগ্রহী নয়। তখন কোম্পানিগুলো বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করে—হয় তারা বাংলাদেশের কারখানাগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে দাম কমাতে, নয়তো উৎপাদন সরিয়ে নেয় অন্য কোনো দেশে, যেমন ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ায়।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো তখন টিকে থাকার জন্য নানা রকম চাপের মুখে পড়ে। তারা চেষ্টা করে উৎপাদন খরচ কমাতে, যার অর্থ হয়তো কম মূল্যে কাঁচামাল কেনা, শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস বা কর্মঘণ্টা বাড়ানো। এতে শ্রমিকের আয় কমে যায়, কাজের পরিবেশ খারাপ হয় এবং সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়ে। সরকারকেও তখন বিদ্যুৎ, গ্যাস কিংবা কর হ্রাসের মাধ্যমে শিল্প খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যার প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আদায়ে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এই অর্থনৈতিক চিত্রকে আরও জটিল করে তুলেছে। সাম্প্রতিক দশকে বৈশ্বিক বাণিজ্য এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, জিও-ইকোনমিক দ্বন্দ্ব এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতা সরাসরি বাণিজ্যনীতিকে প্রভাবিত করছে। এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল—চীন মার্কিন বাজারে অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছে, বাণিজ্য ঘাটতি বাড়াচ্ছে এবং প্রযুক্তি চুরি করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে মার্কিন পণ্যের ওপর।