
বাংলাদেশের নদীতে চীনের সহায়তা: ভালো না মন্দ?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় চীনা সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। নদী ব্যবস্থাপনাগত প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। চীনের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি দ্বারা উপকৃত হওয়ার প্রতি বাংলাদেশের উৎসাহ যুক্তিপূর্ণ।
বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় চীনা সহযোগিতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের আগে আগে। সে সময় খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে চীন ১১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিতে প্রস্তুত।
অনেকেই এই ঋণের সুযোগ নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নে উৎসাহী হয়। সেই সূত্রে পাওয়ার চায়না নামক চীনা কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একটি আলোচনা শুরু হয়। সেই আলোচনার সূত্র ধরে এই মর্মে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় যে এই কোম্পানি বাংলাদেশের সব বড় নদ-নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং যমুনা নদীকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘স্থায়িত্বশীল নদী ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি’ প্রণয়ন করবে।
তবে বিগত সরকার ভারতের কাছ থেকে তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য নদীবিষয়ক চীনা সহযোগিতার বিষয়টিকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। সেই সূত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পাওয়ার চায়নাকে যমুনা নদীর পরিবর্তে তিস্তা নদীর প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ করে।
সে অনুযায়ী পাওয়ার-চায়না ‘তিস্তা নদী সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ প্রণয়ন করে। পরে জানা যায় যে ভারত নিজেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর ফলে তৎকালীন সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়।
চীনে অবস্থানকালে প্রধান উপদেষ্টা চীনা কোম্পানির মাধ্যমেই তিস্তাবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, চীনের পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি চীনের কাছে বাংলাদেশের নদ-নদীবিষয়ক ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার জন্য বিদেশি সরকার কিংবা সংস্থা দ্বারা মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের অতীত অভিজ্ঞতা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।
২.
পঞ্চাশের দশকে ক্রুগ কমিশনের সুপারিশক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (আইইসিও) বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতে আইইসিও ১৯৬৪ সালে দুই খণ্ডের মাস্টারপ্ল্যান
প্রস্তুত করে।
এই মহাপরিকল্পনার সময়-প্রেক্ষিত ছিল ২০ বছর। কিন্তু মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে নদী ব্যবস্থাপনার যে ধারা বাংলাদেশে সূচিত হয়েছিল, প্রায় ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশে মোটাদাগে সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে।
নদ-নদীর প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আইইসিও যে পন্থার প্রচলন করে, তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ‘বাণিজ্যিক পন্থা’। বদ্বীপের জন্য এর সুনির্দিষ্ট রূপ হলো ‘বেষ্টনী পন্থা’।
এই পন্থার মূল লক্ষ্য হলো, প্লাবনভূমিকে নদীখাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। সেই লক্ষ্যে সারা দেশে অসংখ্য বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেটসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। (সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি বইয়ে আমি এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা উপস্থিত করেছি। বই দুটো হলো, বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: বর্তমান ধারার সংকট এবং বিকল্প ধারার প্রস্তাব এবং ওয়াটার ডেভলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার)
খালি চোখেও আইইসিওর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলাফল স্পষ্ট; দেশের নদী ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অসংখ্য নদী হারিয়ে গেছে, বাকিগুলোও মুমূর্ষু। একদিকে নদীখাতগুলো ভরাট করা হয়েছে, অন্যদিকে প্লাবন ভূমির অবক্ষয় সাধিত হয়েছে।