
বাংলাদেশে ‘র’-এর কার্যক্রম পূর্ণমাত্রায় অব্যাহত রয়েছে
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতে যে মাত্রায় আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, এখন বোধহয় আর নেই। ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর ভারত বিষয়ে ট্রাম্পের নানাবিধ গতিবিধি ভারত ও তার নাগরিকদের আশাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছে ট্রাম্প যেদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী শতাধিক ভারতীয় নাগরিককে হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। দ্বিতীয় ধাক্কাটি ছিল, মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের কাছ থেকে প্রত্যাশিত উত্তর না পাওয়ায়। তাদের প্রত্যাশা ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের নিন্দা করে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে হুঁশিয়ারি দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ট্রাম্প প্রশ্নটি আমলে না নিয়ে সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। তবে সর্বশেষ যে ঘটনায় ভারতের নাক কাটা গেছে তা হলো, মার্কিন সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ যা ‘র’ নামে পরিচিত; এই সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার কারণে। ওই প্রতিবেদনে ট্রাম্পের বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়েও বেশ কয়েকটি নিগেটিভ মন্তব্য করা হয়েছে।
২০২৩ সালে মার্কিন নাগরিক খালিস্তানি নেতা গুরুপতবন্ত সিংপান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর জড়িত থাকার কারণে এ সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও ভারত তখন জানিয়েছিল ওই ঘটনায় ভারত সরকারের কোনো যোগ ছিল না। তবে এ হত্যা ষড়যন্ত্রে ‘র’ জড়িত নয় এমন কোনো দাবি ভারত তখন করেনি। এ ঘটনা প্রকাশের পর দেখা গেল ভারত সরকার (সম্ভবত তদন্ত শেষে) ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিকাশ যাদব নামের ‘র’-এর এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে। তবে এ হত্যা ষড়যন্ত্রে সরকার জড়িত ছিল না বলে ভারত যে দাবি করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর কারণ, ১৯৬৮ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে পুনর্গঠিত করে যখন ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস বা ‘র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এ সংস্থাটিকে একটি সাংবিধানিক উইং হিসাবে কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের অধীন ন্যস্ত করা হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ সংস্থাটি সরাসরি সরকারপ্রধানের অনুমতিক্রমেই তাদের সব কার্যক্রম পরিচালিত করে আসছে। সংস্থাটি এমনই ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে, তাদের যে কোনো কার্যকলাপের জন্য তারা ভারতীয় পার্লামেন্টের কাছেও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমন একটি স্পর্শকাতর (পান্নু হত্যা ষড়যন্ত্র) ঘটনার সঙ্গে ভারত সরকারের যোগ নেই বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভারত অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রতিবাদ করেছে।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘র’-এর জড়িত থাকার অভিযোগ নতুন নয়। ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডায় খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার অভিযোগ আছে ভারতের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মাসহ একাধিক ভারতীয় কূটনীতিককে ‘সন্দেহভাজন ব্যক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত করে কানাডা থেকে বহিষ্কার করা হয়। তা ছাড়াও ওই একই বছর ৩৮ দিনের ব্যাধানে ‘র’-এর বিরুদ্ধে আরও দুটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালের ৬ মে পাকিস্তানের লাহোরে গুলি করে হত্যা করা হয় খালিস্তানপন্থি কমান্ডো ফোর্সের প্রধান পরেন্জিৎ সিংপানজোয়ারকে। এরপর ১৪ জুন ব্রিটেনের একটি হাসপাতালে খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের প্রধান অবতার সিং খান্ডার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। অভিযোগ, ভাড়াটিয়া গুন্ডা লাগিয়ে হিন্দি ফিল্ম স্টাইলে ‘র’ এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা হঠাৎ করেই যেন পালটে যায়। এজন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারপর থেকেই ভারত সরকারের সব মেশিনারিজই বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ভারতের ‘র’ পূর্ণমাত্রায় তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তি, মুখচেনা কিছু সাংবাদিক, কলামিস্ট, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক দলের ভেতর পুনরায় ‘র’-এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অতীতের মতোই এই শ্রেণির ব্যক্তিরা ‘র’-এর পারপাস সার্ভ করে যাচ্ছেন। বলা যায়, এসব ব্যক্তি পুরোপুরি ‘ভারতীয় মাউথপিস’ হিসাবে কাজ করছেন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘র’ কিংবা ভারত যা বলতে চায়, এসব ব্যক্তির মাধ্যমে তারা তাই বলিয়ে নিচ্ছে। ‘র’ তাদের এ কাজ আদায়ের জন্য নানাবিধ বরাদ্দ ও প্রলোভন দেখিয়ে থাকে। অন্যান্য অনেক সুবিধা দেওয়া ছাড়াও অর্থ প্রদান, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া কিংবা সম্মাসূচক খেতাব প্রদানের মাধ্যমে তাদের পক্ষে কাজ করিয়ে থাকেন। মূলধারার গণমাধ্যম, ব্যক্তিগত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশনের টক শো কিংবা রাজনীতির ময়দানে তাকালেই আমরা ‘র’ তথা ভারতের পারপাস সার্ভ করছেন এমন ব্যক্তিদের সহজেই চিহ্নিত করতে পারি।