বাংলাদেশের কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির বড় সমস্যা কৃষিজমির সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে জনপ্রতি কৃষিজমির প্রাপ্যতা ০.১১ একর। মোট কৃষি খামারের সংখ্যা ১,৬৮,৮১,৭৫৭। নিচের ৯১.৭০ শতাংশ কৃষক প্রান্তিক ও ছোট।
তাঁদের দখলে আছে ৬৯ শতাংশ কৃষিজমি। ওপরের ৮.৩ শতাংশ কৃষক মাঝারি ও বড়। তাঁরা ৩১ শতাংশ জমি চাষাবাদ করছেন। সম্প্রতি মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
বৃদ্ধি পাচ্ছে ছোট কৃষকের সংখ্যা। এতে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বশেষ কৃষি শুমারির (২০১৮-১৯) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট কৃষি খামারের সংখ্যা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত কৃষি শুমারির তুলনায় ২০১৯ সালে ১১.১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় খামারগুলোর নিয়ন্ত্রণে জমি কমেছে ৪৬.১৮ শতাংশ।
মাঝারি খামারগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা জমির পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে ৩৬.০৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ৩২.২৪ শতাংশ জমি বেশি দখলে নিয়েছে ছোট খামারগুলো। তারা সাধারণত খোরপোশ পর্যায়ে চাষাবাদ করে। বাজারজাত উদ্বৃত্ত তাদের তেমন থাকে না। উৎপাদনে আধুনিক উপকরণ ব্যবহার ও ভূমি উন্নয়নে তাদের আগ্রহ থাকে কম।
প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তি ও কৃষি যন্ত্র সংগ্রহে তাদের প্রবেশাধিকার কম। ফলে তাদের প্রতি ইউনিট জমির উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার কম। অন্যদিকে বড় ও মাঝারি কৃষকরা ক্রমাগতভাবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষাবাদে। তাঁরা ক্ষয়িষ্ণু কৃষক। চাষাবাদে তাঁদের বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তাঁদের উৎপাদন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।
কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা এখন কৃষকদের অনুকূলে নয়। এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বড় ব্যবসায়ী, মিলার ও তাঁদের দ্বারা সংগঠিত সিন্ডিকেটের হাতে। বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য তাঁরাই নির্ধারণ করেন। এতে উৎপাদনকারী কৃষক ও ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারে খামার প্রান্তের ক্রয়মূল্য ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য বেশি। এর পুরো সুবিধা নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তাঁরা শস্যের প্রক্রিয়াজাত করেন, মূল্য সংযোজন করেন এবং বাজারে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে উৎপাদনকারীরা চালের ভোক্তা-মূল্যের ৭১ শতাংশ থেকে বঞ্চিত হন। এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কারণ খাদ্যশস্য মজুদের ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা কম। ব্যবসায়ী ও মিলারদের সক্ষমতা অনেক বেশি। বর্তমানে সরকারের খাদ্যশস্য মজুদের সক্ষমতা মাত্র ২২ লাখ টন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও ছোট-বড় মিলারদের মজুদ সক্ষমতা প্রায় এক কোটি টন। শুধু ধান-চালের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও কৃষকরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবার আলু ও সবজির মূল্য ধসে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উৎপাদনকারী কৃষকরা। জমি চাষ, শ্রমিকের মজুরি, বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ উচ্চহারে পরিশোধ করে তাঁরা অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কৃষিকাজে বড় দাগে লোকসান দিয়ে তাঁদের অনেকেই এবার পথে বসেছেন।
বাংলাদেশকে আমরা প্রায়ই খাদ্যে স্বনির্ভর বলে দাবি করি। কথাটি তেমন অর্থবহ নয়। কারণ প্রতিবছরই আমরা বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানি করছি। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। তেল, ডাল, পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলার ক্ষেত্রেও আমাদের বড় নির্ভরতা আমদানির ওপর। প্রতিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারের আকার প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।