অল্পের জন্য রক্ষা, সবার জন্য শিক্ষা

ঢাকা পোষ্ট বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২৫, ২০:০৭

জনপ্রিয় তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়া এবং আরোগ্য লাভ করা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। উদ্বিগ্নতা, প্রার্থনা, স্মৃতিকাতরতায় ছেয়ে যায় গণমানুষের অভিব্যক্তিসমূহ। একই সাথে বেশ কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। একজন লিখেছেন, ‘তামিম ইকবালের মতো ৩৬ বছরের, পিক ফর্মে থাকা অ্যাথলেটের যদি ১০০% ব্লক থাকে, যেজন্য হার্টই বন্ধ হয়ে যায়, তবে আপনি সুস্থ আছেন তো?’ আরেকজন লিখেছেন, ‘তামিম এত খেলাধুলা দৌড়াদৌড়ি ব্যায়ামের পর তার হার্ট ব্লক! আমার আর হেঁটে কী হবে? ধর বন্ধু আমার কেহ নাই’। এসব প্রশ্ন বা সংশয়ের উত্তর প্রয়োজন। যে সরল যুক্তির ভিত্তিতে মানুষ বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে তা বৈজ্ঞানিকভাবে খণ্ডন করা জরুরি। সেজন্যই কলম ধরা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হলে হার্ট, ব্লক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি সম্বন্ধে মৌলিক কিছু আলোচনা হওয়া দরকার।


প্রথমে হার্ট বা হৃদপিণ্ড কী? সাহিত্যের ভাষায় Heart is the most poetic organ of the human body অর্থাৎ ‘হৃদয় হচ্ছে মানবদেহের সবচেয়ে কাব্যিক অঙ্গ’। হার্ট দান করা যায়, তবে কেবল মৃত মানুষের দেহ থেকে। কিডনি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দান করা অঙ্গ, তারপর রয়েছে লিভার এবং চোখের কর্নিয়া; হার্টের ক্রম আরও পরে। তবে পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে নিজের হৃদয় নিজের কাছে রাখতে চায়, প্রত্যেকেই তার প্রিয়জনকে দিয়ে দিতে চায়, বিনিময় শর্ত আছে, গ্রহীতার হৃদয়টাও তার চাই। কেউ তা পায়, কেউ তা পায় না। তাই নিয়ে আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত আবেগ-উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। এ বিষয়টা সবচেয়ে বেশি জানে কবি-সাহিত্যিকরা, তাই কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া সব কবি-সাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে হৃদয় নিয়ে। উদাহরণ দিয়ে কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না; শুধু একটা উল্লেখ করি। দৃষ্টি-বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী প্রতিভা হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং সেরা জিনিসগুলো দেখা যায় না, এমনকি স্পর্শও করা যায় না - সেগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।’ বাস্তবে হার্ট হচ্ছে একটি পেশিবহুল অঙ্গ (মুষ্টির আকারের প্রায়) যা মানুষের বুকের কেন্দ্রের সামান্য বাম দিকে অবস্থিত। এটি বস্তুত একটি পাম্পিং যন্ত্রের মতো কাজ করে। হার্টবিট অর্থাৎ সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে সে সারা শরীরে রক্ত পাম্প করে। দেহে আপাদমস্তক জালের মতো ছড়িয়ে থাকা রক্তনালীর (শিরা) মাধ্যমে দূষিত (কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত) রক্ত হার্টে জমা হয়, হার্ট তা পাম্প (সংকোচন) করে ফুসফুসে পাঠায়। ফুসফুসে প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংগৃহীত অক্সিজেনের মাধ্যমে ঐ দূষিত রক্ত বিশুদ্ধ (অক্সিজেন মিশ্রিত) হয় এবং হার্টে (প্রসারিত অবস্থায়) ফেরত আসে। হার্ট এরপর পাম্প (সংকোচন) করে এই বিশুদ্ধ রক্ত রক্তনালী (ধমনী) দিয়ে দেহের সব টিস্যু এবং অঙ্গে পৌঁছায়। রক্ত অক্সিজেনের সাথে পুষ্টিও বহন করে; অক্সিজেন ও পুষ্টির মাধ্যমে টিস্যু তথা অঙ্গ তথা শরীর বেঁচে থাকে, নচেৎ মৃত্যুবরণ করে। হার্ট তো অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু ওর নিজেকে তো আগে বেঁচে থাকতে হবে। ওকে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের কাজটা কে করে থাকে? এ কাজটা করে থাকে করোনারি আর্টারি, যেগুলো হচ্ছে হার্টের নিজস্ব রক্তনালী। করোনারি আর্টারিসমূহ হার্টে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে হার্টকে সচল রাখে।


এখন দেখা যাক, হার্ট অ্যাটাক কী? হার্টকে কে অ্যাটাক মানে আক্রমণ করে? হার্ট অ্যাটাক হৃদপিণ্ডের পেশির কোনো অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ঘটে। করোনারি আর্টারিতে কোনো ব্লক থাকলে তা অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তকে হৃদপিণ্ডের টিস্যুতে পৌঁছাতে বাধা দেয়, যা হৃদপিণ্ডের পেশির সেই অংশের ক্ষতি করতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। ব্লকেজের কারণে হৃদপিণ্ড নিজেই নিজেকে আক্রমণ করে থাকে, এজন্য একে হার্ট অ্যাটাক বলা হয়। সাধারণত করোনারি আর্টারির ভেতরে চর্বি (fat deposits) জমা হওয়ার কারণে এই ব্লকেজ হয়; ফ্যাটি ডিপোজিটগুলো প্লাক (plaque) তৈরি করে। সময়ের সাথে সাথে প্লাক করোনারি আর্টারির নালি পথকে সংকুচিত করতে পারে, যার ফলে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। যদি প্লাকটি ফেটে যায়, তাহলে এটি এমনভাবে জমাট বাঁধে যা হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় এবং ফলশ্রুতিতে হার্ট অ্যাটাক হয়। এভাবে ধারণা করা যেতে পারে- রান্নাঘরের বেসিন বা সিঙ্কের বর্জ্য (চর্বি)-এর মাধ্যমে আটকে যাওয়া পাইপ (রক্তনালী) দিয়ে পানি (রক্ত) প্রবাহিত হতে পারছে না, তাই বেসিন বা সিঙ্ক (হৃদপিণ্ড) সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হার্ট অ্যাটাককে 'মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন' (myocardial infarction) বলে। হার্টের মাংসপেশিকে মায়োকার্ডিয়াম বলে আর ইনফার্কশন বলতে রক্ত সরবরাহের অভাবের কারণে টিস্যুর মৃত্যুকে বোঝায়। যখন মায়োকার্ডিয়ামের কোনো অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আক্রান্ত হৃদপিণ্ডের পেশি অক্সিজেন-বঞ্চিত হয়ে মারা যেতে শুরু করে। এই ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে ‘ইনফার্ক্টেড টিস্যু’ বলা হয়।



হার্ট অ্যাটাকের সতর্কতাসূচক লক্ষণসমূহ হচ্ছে: বুকে ব্যথা/চাপ (মনে হবে যেন বুকের উপর ভারী পাথর চেপে ধরা হয়েছে), বাহু, চোয়াল বা পিঠে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা ঘাম, বমি বমি ভাব। হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা নির্ভর করে হৃদপিণ্ডের পেশি কতটা ব্লকের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কত দ্রুত রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধার করা হয় তার ওপর। এখানে আরেকটা ঘটনা ঘটে, সেটা হচ্ছে ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (cardiac arrest) অর্থাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া। এটি বৈদ্যুতিক সমস্যা। হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, যার ফলে তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, এটা হৃৎপিণ্ডে ‘বিদ্যুৎ বিভ্রাটের’ মতো, কারণ রক্ত সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হার্ট বিট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিষ্কে/শরীরে রক্ত পাম্প করা হয় না, নাড়ি (pulse) পাওয়া যায় না।


কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সতর্কতাসূচক লক্ষণসমূহ হচ্ছে: শরীর হঠাৎ পড়ে যাওয়া (collapse), শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকা/হাঁপানি বন্ধ হওয়া, জ্ঞান হারানো (কোন প্রতিক্রিয়া না থাকা)। তাহলে দাঁড়ালো- হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে প্লাম্বিং সমস্যা (রক্তনালী আটকে যাওয়া), আর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক ব্যর্থতা (হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যাওয়া)। হার্ট অ্যাটাক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টকে উসকে দিতে পারে, কিন্তু দুটো একই বিষয় নয়।


এবারে আসা যাক তামিমের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল সে প্রসঙ্গে। সেদিন সকাল থেকে বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে বসুন্ধরা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০২৪-২৫ মৌসুমের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বনাম শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচ ছিল। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে মাঠে ছিলেন তামিম ইকবাল। খেলা শুরুর কিছুক্ষণ আগে তামিম হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। প্রথমে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট তাকে অ্যাটেন্ড করেন এবং গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি ভেবে কিছু ওষুধ খেতে দেন। একই সাথে বিকেএসপির একজন স্পোর্টস মেডিসিন স্পেশালিস্ট চিকিৎসককে জরুরি তলব করা হয়। তিনি দ্রুতই আসেন। তামিম তাকে জানান যে ব্যথাটা বুক থেকে চোয়ালের দিকে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে হালকা কমছে। তামিমও মনে করছেন এটি অ্যাসিডিটির ব্যথা। কিন্তু অ্যাসিডিটির ওষুধ খাওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেলেও প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর ব্যথা আবারও তীব্র হয়ে ওঠে। তখন দ্রুত তাকে বিকেএসপির অনতিদূরে অবস্থিত ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজে’ নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইমারজেন্সিতে ইসিজি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় টেস্ট ( যেমন রক্তের ট্রপোনিন-আই) করানো হয়। ইসিজি রিপোর্টে শুধু ব্রাডিকার্ডিয়া (হার্ট বিট কমে যাওয়া) ধরা পড়ে। কিন্তু ট্রপোনিন-আই অনেক বেশি আসে, যা হার্ট অ্যাটাক হওয়াকে নিশ্চিত করে। রোগীকে ভিভিআইপি কেবিনে শিফট করা হয়। হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা অবিলম্বে শুরু করতে তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি দামি বহুজাতিক কর্পোরেট হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার পক্ষ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স (হেলিকপ্টার) ডাকা হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসাপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. রাজীব হাসান, কার্ডিওলজিস্ট ডা. মারুফ প্রমুখের সনির্বন্ধ অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি উপর থেকে নিচে নেমে সড়ক পথের অ্যাম্বুলেন্সে গিয়ে বসে পড়েন। হাসপাতালের একজন ইমার্জেন্সি চিকিৎসক ও নার্স সাথে দিয়ে দেওয়া হয়। হেলিকপ্টার বিকেএসপির অ্যাথলেটিক্স গ্রাউন্ডে অবস্থান করছিল। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স বিকেএসপিতে ঢোকার পরমুহূর্তেই রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যায় এবং তিনি পুরো শরীরটি ছেড়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পালস, ব্লাড প্রেশার কোনটাই পাওয়া যাচ্ছিল না। সাথে থাকা ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালের চিকিৎসক সেই মুহূর্তেই তাকে ইমারজেন্সি কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর CPR) প্রদান শুরু করেন। তখন আর হেলিকপ্টারে ওঠানোর সময় বা সুযোগ কোনোটাই ছিল না। দ্রুতগতিতে তাকে ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে ফেরত আনা হয়। পথিমধ্যে সিপিআর দেওয়া অব্যাহত থাকে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই ইমারজেন্সিতে কোড ব্লু কল করা হয়। কার্ডিওলজিস্ট ডা. মারুফের নেতৃত্বে অ্যানেসথেশিওলজিষ্ট ডা. মনিরুজ্জামান, ডা. রাসেল আরাফাত, ডা. রঞ্জন কুমার মণ্ডল, ইন্টার্নাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অমল কৃষ্ণ পাল, ডা. আদনান বুলবুলসহ একদল নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ চিকিৎসক রোগীর জীবন বাঁচাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়, ইনটিউবেট (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য শ্বাসনালীর ভেতর নল ঢোকানো) করা হয়। ২২ মিনিট সিপিআর ও ৩ বার শক (DC shock) দেওয়া পর ক্যারোটিড পালস (ঘাড়ের রক্তনালীর স্পন্দন) পাওয়া যায়। সাথে সাথে ক্যাথ ল্যাবে নিয়ে এনজিওগ্রাম (angiogram) করা হয়। এরপর প্রাথমিক পিসিআই (primary PCI) করে ১০০% বন্ধ রক্তনালী খুলে দেওয়া সম্ভব হয়। তার লাইফ সাপোর্ট প্রত্যাহার করা হয়। পরদিন রোগী সুস্থ দেহে ওই হাসপাতাল ছেড়ে যান।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও