
শয়তানের স্বরূপ কেমন?
“আসল শয়তান লুকিয়েছিল শয়তান ধরার কার্যক্রমে”— ‘হেল স্যাটান’ ছবির পরিচালক পেনি লেন।
প্রথমেই বলে রাখছি, এই লেখাটি মানুষের পক্ষে, শয়তানের বিপক্ষে। অন্যায় বা পাপ করার মানুষের যে ইন্দ্রিয় বা রিপু— শয়তান সেও। মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেন, সে আসলে শয়তানের পক্ষে থাকতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীটা বড় বিচিত্র। শয়তান নিয়ে কারও কারও ভিন্ন ভাবনাও রয়েছে। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, এই পৃথিবীতে শয়তানকে ভালো বলেন এমন মানুষও রয়েছেন এবং এদের সংখ্যা কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার। বিবিসির রিপোর্ট এবং মার্কিন নির্মাতা পেনি লেন নির্মিত চলচ্চিত্র ‘হেল স্যাটান’ দেখলে অবাক হতে পারেন। পেনি লেন তার ডকুমেন্টারি টাইপের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন যে, স্রষ্টার বিপরীতে প্রথম প্রতিবাদকারী হচ্ছে শয়তান (নাউজুবিল্লাহ)!
চলচ্চিত্রটিতে ২০১৩ সালে শয়তানের মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ধর্ম বিশেষ করে খ্রিস্টধর্ম মার্কিনিদের জীবনে যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে তার বিপরীতে শয়তানের মন্দির কীভাবে কাজ করছে সেটা তুলে ধরা হয়। শয়তানের মন্দিরে আসা মানুষের ভাবনা এমন—শয়তান হচ্ছে মুক্তচিন্তা ও বাক স্বাধীনতার প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত শয়তানের মন্দিরে শয়তানের রূপক বেফোমেটের ভাস্কর্য পুরোপুরি পূজার জন্য নয়। শয়তানের অনুসারীরারা মনে করেন ধর্ম পুরোপুরি বিশ্বাসের জায়গা যেখানে প্রমাণের কোনো ব্যাপার নেই। শয়তানের অনুসারীরা বিশ্বাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত! ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে ও বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতে শেখানো হয় মন্দিরে। মনের ইচ্ছানুযায়ী বিবেক দ্বারা পরিচালিত মানবিক গুণ বিকাশ করাই নাকি তাদের উদ্দেশ্য।
শুভবোধের বিপরীতে অশুভের মতো প্রাচীনকাল থেকে ভালো দেবতাদের পাশাপাশি মন্দ দেবতাও ছিল। গ্রীক বা রোমানীয় পুরাণে ‘দিয়াবল’ টাইপের মন্দ কেউ ছিল না। পাশাপাশি ইরানের প্রাচীন বিশ্বাসে সর্বোৎকৃষ্ট দেবতা আহুরা মাজদার বিপরীতে অ্যারিম্যানকে পাওয়া যায়, যে কিনা মন্দ কাজ করাকেই ব্রত মনে করে। ইসলাম ধর্মে মূল শয়তানের নাম ইবলিশ। অনেকেই বলেন, ইবলিশ শব্দটা গ্রীক ডায়াবোলাস বা দিয়াবল থেকেও উদ্ভূত হতে পারে। ইবলিশই সকল নষ্টের মূল। ইবলিশের কারণে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া স্বর্গ ছেড়েছিলেন। সকল পাপ ও কুমন্ত্রণার মূলে এই ইবলিশ শয়তান।
মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের আগেই ইয়াজিদি নামের এক সম্প্রদায় ছিল যারা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু এখন। যাদের অনুসারীর সংখ্যা সারা পৃথিবীতে সাত লাখের মতো। জেরুজালেম বা মক্কার মতো এদের পূণ্যভূমি ইরাকের মসুলে অবস্থিত লালিস নামের এক জায়গা। তাদের বিশ্বাস এমন— আল্লাহ পৃথিবী ও মানুষের মঙ্গলের জন্য সাতজন ফেরেশতা তৈরি করে মানুষকে সেজদা করতে বলেন তাদেরকে। ছয়জন নির্দেশ মানলেও একজন ফেরেশতা সেটা মানেননি। তাকেই মানুষ ও পৃথিবীর দায়িত্ব দেন আল্লাহ এবং ওই ফেরেশতা ময়ূর হয়ে আসেন পৃথিবীতে। একারণে খ্রিস্টান এবং মুসলিম দুই ধর্মের অনুসারীরা ইয়াজিদিদের শয়তানের পূজারী মনে করে থাকে। দিনে পাঁচ বেলা প্রার্থনা, তিন দিনের উপবাস, লালিসের পুণ্যভূমিতে প্রার্থনায় যাওয়া এমন ধর্মীয় নিয়ম থাকলেও ইসলামিক স্টেট (আইএস) ইয়াজিদিদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন, নিপীড়ন চালায়। পলায়নপর ইয়াজিদিরা ইরাক, তুরষ্ক বা সিরিয়ার বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করে থাকে বলে জানা গেছে।
শয়তান নিয়ে এত আলোচনার মূল কারণ গত ৮ ফ্রেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ‘ডেভিল হান্ট’। এর মানে শয়তান শিকার। এর আগে অবশ্য ‘ডেভিলস ডাবল’, ‘রেড ডেভিল’ বা ‘ডেয়ার ডেভিলস’ নিয়েও কথা আসতে পারে। ‘হেল স্যাটান’ ছবির মতো ‘ডেভিলস ডাবল’ চলচ্চিত্রটাও দেখতে পারেন। লিও ট্যামহোন পরিচালিত ‘ডেভিলস ডাবল’ ছবিটা ইরাকের সাদ্দামপুত্র উদে হোসেনকে নিয়ে। লতিফ নামের এক সৈনিককে আনা হয় যে দেখতে উদের মতো। তাকে উদের ডামি হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ছবির কাহিনি সাদ্দাম ও তার দুই পুত্র উদে ও কুসের নির্মমতা ও বিভিন্ন অঘটন নিয়ে। ‘ডেভিলস ডাবল’ যতটা নেগেটিভ ‘রেড ডেভিল’ ততটাই তার বিপরীত। ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে আদর করে বলা হয় ‘রেড ডেভিল’। তার মানে শয়তান কখনো-সখনো আদরেরও হতে পারে। যারা শয়তানের পূজারী তারা নাকি কালো রং পছন্দ করে। বেদনার রং যেমন নীল, বিপ্লবের রং যেমন লাল তেমনি অশুভের রং নাকি কালো। যদিও ম্যানচেস্টারের জার্সির রং লাল। এমনকি ভারতের টি-টুয়েন্টি ম্যাচের একদা আলোচিত টিম ‘ডেয়ার ডেভিলস’-এর নামটাও আলোচনায় আসতে পারে। শয়তান তাহলে সাহসীও হতে পারে?
ডেভিলহান্টের ডেভিল কারা? নাকি তারা শুধুই একটি দলের পলাতক নেতা, কর্মী বা সমর্থক কিনা এই প্রশ্নটা আমি করছি, এটি করা হয়েছিল বিবিসির একটা রিপোর্টে। ভালো কথা, খবরের কাগজের তথ্য অনুযায়ী ডেভিলহান্ট পরিত্যক্ত হয়েছে, তবে যৌথবাহিনীর অভিযান চলবে। বিবিসির রিপোর্টে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার দেয়া রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বলেছে– “জেলায় জেলায় অভিযান চলানোর পরও দেশের আইনশৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বরং অভিযান চলার মধ্যেই একের পর এক ডাকাতি, প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই, গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, 'তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাধা, মব সৃষ্টি করে বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, এমনকি পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে।” রিপোর্টের একটা অংশে বলা হয়েছে, “এদিকে, অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বড় অংশই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বলে জানা যাচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্নও উঠছে।” বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে। আব্বাস বলেন “দেশে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলছে। ‘শয়তান’ শিকার করতে গিয়ে যেন ভালো লোক ধরা না পড়ে।” তিনি আরও বলেন “এই শয়তান শিকার করার জন্য বনে-জঙ্গলে ঘুরার দরকার কি ভাই। শয়তান তো আপনার আশেপাশেই আছে। এই সরকারের সঙ্গে আছে, সামনে আছে, পেছনে আছে, সচিবালয়ে আছে, ওদের আগে ধরেন।”
- ট্যাগ:
- মতামত
- যৌথ বাহিনীর অভিযান