
অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের মিল-অমিল
বাংলাদেশে নতুন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে গত আগস্টে, শ্রীলঙ্কায় সেপ্টেম্বরে। উভয় সরকার প্রায় একই ধাঁচের দুই গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। লঙ্কার রাজনৈতিক সংগঠকেরা গণ–অভ্যুত্থান শেষে দীর্ঘ দুই বছর মাঠে সক্রিয় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেল। বাংলাদেশে অনির্বাচিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টারা ক্ষমতায়।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পরিবর্তনের ওপর নজর রাখছে বিশ্বের অনেকে। দেখতে চাইছে উভয় সরকার কীভাবে নিজ নিজ জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণ করে; বিশেষ করে, যখন তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অনেকখানি আইএমএফের হাতে।
আন্দোলনের শক্তিগুলো লঙ্কাকে যেভাবে চালাচ্ছে
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় গত সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরে হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। উভয় নির্বাচনে জেভিপির (জনতা বিমুক্তি পেরামুনা) নেতৃত্বে এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার) ক্ষমতা পায়। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে; প্রধানমন্ত্রী হরিণী অমরাসুরিয়া। উভয়ে প্রায় সমবয়সী এবং বয়স ষাটের নিচে।
জেভিপি শুরুতে চমক দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়োগ দিয়ে। দেশটিতে মোট ভোটারের ৫৬ শতাংশ নারী। তবে গণ–অভ্যুত্থানে নারীদের বড় ভূমিকা ছিল বলে সরকার এমন করেছে, বিষয়টা তা নয়। এই নিয়োগের ভেতর দিয়ে দলটি অতীতের ‘কট্টর’ বামপন্থী ইমেজ ভেঙে মধ্যপন্থায় পক্ষপাতের কথা জানাচ্ছে।
দেশটিতে কারও স্ত্রী বা কন্যা না হয়ে কোনো নারী যোগ্যতার জোরে দেশের সর্বোচ্চ স্তরের কোনো পদে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। অন্যান্য নিয়োগেও এনপিপি কুলীন রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের মানুষদের নিয়োগ দিয়ে চলেছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ দীর্ঘ সাত দশক ধরে তথাকথিত এক দ্বিদলীয় কুলীন শাসনে ক্লান্ত। অভ্যুত্থানের এক নীরব চাওয়া ছিল এই সাজানো ছক ভাঙা। জেভিপি সে কাজ করে চলেছে ধীর লয়ে।
দেশের সবকিছুকে সিংহলি-তামিল মেরুকরণে দেখার বদলে জেভিপি সমস্যাগুলো ধনী-গরিবের চোখ দিয়ে দেখছে, সেভাবে সমাধানের কথা বলছে। সে কারণেই সিংহলি প্রধান দল হয়েও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা জাতিগত বিষয়গুলো সামনে আনা থেকে বিরত থেকেছে।
এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার সম্ভাবনার পরও জেভিপি সমমনা ছোট ছোট সংগঠনের সঙ্গে জোট গড়েছে। এই জোটে আছেন বিভিন্ন কর্মজীবী-পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ রকম জোটের কারণে অনূঢ়া প্রতিনিয়ত সমাজের সব স্তর থেকে চাওয়া-পাওয়ার বার্তা পাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী অর্থনৈতিক নীতিকৌশল ঠিক হচ্ছে। অনেক পেশাজীবী সংগঠকদের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে। জোটের সাংগঠনিক চেহারার কারণেই এনপিপি জোটের প্রথম রাষ্ট্রীয় বাজেট বেশ ব্যবহারিক ধাঁচের হয়েছে।
নতুন সরকার অর্থনৈতিক কাজে হাত লাগিয়েছে তিন অগ্রাধিকার সামনে রেখে: দারিদ্র্য কমানো, অর্থনীতিকে ক্রমে ডিজিটালাইজ করা এবং জনজীবনকে পরিবেশসম্মত করা। শেষের কাজে তারা পরিবেশসম্মত অর্থনীতির সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির যোগ ঘটাতে চায়। অনূঢ়া মনে করছেন, এতে পর্যটনশিল্প চাঙা হবে।
এ বছর লঙ্কান সরকার কেবল পর্যটন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায়। মার্চের শুরুর সাত দিন দেখা গেল, গড়ে সাড়ে সাত হাজার পর্যটক আসছেন এখানে। তবে বাজেট–ঘাটতি কমাতে বাড়তি রাজস্ব দরকার। সে জন্য সিগারেট, পানীয়সহ এমন কিছু খাতে কর বাড়ানো হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের চাপে ফেলবে কম। সরকারের পরিকল্পনা হলো আগামী ১২ মাসে রাজস্ব ২৩ শতাংশ বাড়ানো। একই সময়ে খরচ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে সীমিত রাখা।
আগের মতোই নতুন বাজেটে সামরিক খাত ব্যয় বরাদ্দের বেশ বড় অংশ পাচ্ছে। ১২ বিলিয়ন রুপি বাড়িয়ে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী এবার পেল ৪৩৭ বিলিয়ন রুপি। জনসংখ্যাপ্রতি সামরিক ব্যয়ে শ্রীলঙ্কা বিশ্বে বেশ এগিয়ে। একই সময় তামিলদের খুশি করতে জাফনার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির উন্নয়নে ১০০ মিলিয়ন রুপি দিয়েছে সরকার। গৃহযুদ্ধের সময় সিংহলি সৈনিকেরা এই লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলাদেশের অর্থনীতি
- গণঅভ্যুত্থান