
আছিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু : মানবতার চরম বিপর্যয়
শেষ পর্যন্ত মাগুরার নির্যাতিত শিশু আছিয়াকে বাঁচানো গেল না। নির্মম নির্যাতনের প্রতীক আছিয়া চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে চলে গেছে। ধর্ষণের শিকার আছিয়া ৯ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করার পর গত ১৩ মার্চ বেলা ২টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছে। আছিয়ার মা মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার মনি চলে গেছে।’ আছিয়া নির্মমতার শিকার হয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে উত্তরহীন এক প্রশ্ন-আমার মতো অবুঝ শিশুর কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই? আমাদের কি এভাবেই বিকশিত হওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী আছিয়ার ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করে বলেছেন, আমরা যারা নারী ও শিশু আছি, তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে হবে অথবা জন্মের সময় জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলার অনুমতি দিতে হবে। একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের এক নেত্রী বলেছেন, ধর্ষক কারও সন্তান নয়, ধর্ষক কারও ভাই নয়, তারা শুধুই ধর্ষক। এভাবে তিনি পরিবার থেকেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্ষকের ব্যক্তিপরিচয় বা রাজনৈতিক পরিচয় অর্থহীন; তারা যে অপকর্ম সংঘটিত করে, তার সঠিক ও দ্রুত বিচার হতে হবে। ধর্ষকদের শাস্তি প্রদানের জন্য আইন আছে, কিন্তু সেই আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। একজন ধর্ষক নানাভাবেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দায়মুক্তি পেতে পারে। আর ধর্ষক যদি আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়, তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিনিয়তই দেশে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আছিয়া চলে গেছে। তার ওপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা ছিল নজিরবিহীন এবং আশা জাগানিয়া। সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছে। ‘আছিয়া’ এখন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যেমন সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে আছে ‘ফেলানী’। আগামীতে যুগ যুগ ধরে আছিয়া নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ হিসাবে বিদ্যমান থাকবে।
মাগুরার আছিয়ার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। এ বয়সে জীবনের জটিল দিক সম্পর্কে তার কোনো ধারণা থাকার কথা নয়। স্কুল রমজানের ছুটি ছিল। তাই আছিয়া তার বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ১ মার্চ। সেখানেই ৫ মার্চ আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষক আর কেউ নয়, তার দুলাভাইয়ের পিতা। অর্থাৎ আছিয়াকে তার ‘তালই’ ধর্ষণ করে। যে তালইকে আছিয়া পিতার মতো সম্মান করত, সেই জঘন্য ব্যক্তিটিই আছিয়ার এমন সর্বনাশ করেছে। সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধর্ষণকাণ্ডে আছিয়ার দুলাভাই তার বাবাকে সহায়তা করে। কতটা নিু রুচির মানুষ হলে এমনটা করতে পারে, তা ভাবলেও বিশ্বাস হতে চায় না। ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার প্রায় ৯ ঘণ্টা পর ৬ মার্চ আছিয়াকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তাকে ফরিদপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। এক সময় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আছিয়ার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। এক সময় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে ১৩ মার্চ তার মৃত্যু হয়। আছিয়া ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর সারা দেশ আন্দোলনে সোচ্চার হয়। তারা ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। আছিয়া ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যমান আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মানুষ কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম হলে ৮ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করতে পারে, তা অনুমান করতেও কষ্ট হয়। আছিয়ার ধর্ষণ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অধঃপতনের চিত্রই ফুটে উঠেছে। দেশের আরও কোনো কোনো অঞ্চল থেকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ধর্ষণ যেভাবে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, অতীতে আর কখনোই এমনটি হয়নি। বিকৃতভাবে ধর্ষণের প্রবণতা বেড়েছে। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের কারণগুলো আমাদের নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো অপরাধকর্ম নতুন নয়। সব সময়ই সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়ে চলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যাপকতা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ যেন ধর্ষণের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীদের কারও কারও মতে, গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরিবর্তন সাধিত হলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব পালনের প্রতি অনীহা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দলীয় ক্যাডারের মতো ভূমিকা পালন করেছে। সেই অপকর্মের কারণে তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। যে কোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। যারা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন, এখন তারা নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। একশ্রেণির পুলিশ সদস্য, যারা বিগত সরকার আমলে অনৈতিক সুবিধাভোগী ছিলেন, তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহের সুযোগে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে নানা কারণেই নারীদের পূর্ণ মাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ দমনের দাবিতে আন্দোলন করছে। এবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকরাও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে ধর্ষণবিরোধী এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মোতাবেক, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুলাই সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে ১০ হাজার ৭০৪টি। একই বছর আগস্ট-ডিসেম্বর সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৬ হাজার ৮৬৭টি। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরের (২০২৪) জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৪৬৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আরও বেড়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুসারে গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে কল এসেছে ৩৪৮টি। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে জানিয়েছে, গত বছর (২০২৪) নারী ও শিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি এবং আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮৬১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন। অন্য একটি সূত্রমতে, গত ১০ বছরে ৫ হাজার ৬০০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিচারে অভিযুক্ত ধর্ষকের শাস্তি পাওয়ার হার খুবই কম। বিচারহীনতা ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে।