
জামাল নজরুল ইসলাম : নিঃসঙ্গ কসমোলজিস্ট
‘রাতের জীবরা দিনের আলোকে আকর্ষণীয় মনে করবে না, যেমন দূর ভবিষ্যতের অতি-শীতল মহাবিশ্বের অজানা সচেতন প্রাণীরা আমাদের উষ্ণ মহাবিশ্বকে হয়তো খুব একটা আরামদায়ক হিসেবে দেখবে না। কিন্তু তবুও, তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে হয়তো পাওয়া যাবে যাদের কল্পনাশক্তি প্রখর, তারা দূর অতীতে, মহাবিশ্বের দিকে ফিরে তাকাবে, দেখবে একটা সূর্যালোক প্লাবিত পৃথিবীকে, যেখানে কয়েক কোটি বছরের শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত, তারা সেই পৃথিবীকে এক স্বপ্নের জগৎ বলেই ভাববে-কিন্তু তাদের জন্য সেই স্বপ্নের জগৎ হারিয়ে গেছে, কোনদিন ফিরে আসবে না। বর্তমানে আমরা যারা এই স্বপ্নের পৃথিবীকে নিয়ে আছি, তারা কী করছি? আমরা একে অপরকে অত্যাচারে জর্জরিত করছি, নিজেদের ধ্বংসের জন্য পরমাণু মারণাস্ত্র তৈরি করছি, আর পৃথিবীর সম্পদকে অবাধে লুঠ করছি, মানবতাকে লঙ্ঘন করছি।’
সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব ইউনিভার্স (The Ultimate Fate of the Universe)’-এর ‘ফিউচার অব লাইফ অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ অধ্যায়ে জামাল নজরুল ইসলাম এ কথাগুলোই লিখে গেছেন।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিখ্যাত কসমোলজিস্ট, গণিতবিদ ও পদার্থবিদ। কেমব্রিজ থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বইটি পড়ানো হয়। পৃথিবীর বাঘা বাঘা পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ীরা ছিলেন তার বন্ধু, সহপাঠী ও সহকর্মী।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে। ওখানে তার সহপাঠী ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার (Jayant Vishnu Narlikar)। সহপাঠী ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন (Brian Josephson), যিনি তার পিএইচডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, ১৯৭৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান।
সহপাঠী ছিলেন রসায়নবিদ জন পোপল (John Pople)। তিনিও ১৯৯৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ষাটের দশকে কেমব্রিজে স্বয়ং পল ডিরাক (Paul Dirac) তাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্লাস নিতে দেন, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (ফিল্ড থিওরি) পড়েছেন জন পোলকিংহোর্ন (John Polkinghorne)-এর কাছে।
বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম যশোরের ঝিনাইদহ শহরে, ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে। মাতামহ শামসুল ওলামা কামালউদ্দিন ছিলেন গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারি কলেজের প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ। মনীষী আবু সয়ীদ আইয়ুব তার মামা। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ‘লালসালু’ উপন্যাসের স্রষ্টা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ফুফাতো ভাই। তার পিতা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিচার বিভাগীয় একজন মুন্সেফ। মা রাহাত আরা ছিলেন উর্দু ভাষার কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটিকাটি সফলভাবে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন।
জামাল নজরুল ইসলাম তার ফুফাত ভাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে ‘উজ্জ্বল স্মৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সারাজীবন বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে গবেষণা করলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-চিত্রকলা এসবের প্রতিও আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এর মূলে রয়েছে আমার পারিবারিক প্রভাব। ...আমার এ আগ্রহের ফলে কোলকাতার অনেক বিখ্যাত গুণীর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি, এর পেছনেও ওয়ালী ভাইয়ের বিশেষ প্রভাব থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। এরই ধারাবাহিতায় রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এরপর প্রাচ্য পাশ্চাত্যের অনেক সাহিত্যিক ও দার্শনিক আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে ও আলোড়িত করেছেন যে, আমি মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে যেমন ভাবি, তেমনি ভাবি আমাদের সমাজ সভ্যতা নিয়ে। ...নিরন্তর এই ভাবনা থেকে হয়তোবা ভালো কিছুর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’