
শেখ সাদী খানকে সরিয়ে বিটিভি কাকে সম্মানিত করল?
শেখ সাদী খান নামের সঙ্গে আপনার পরিচয় না থাকার কোনো কারণ নেই। কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক ও সুরকার। ভালোবেসে অনেকে তাকে ‘সংগীতের জাদুকর’ও বলে থাকেন। সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর ছেলে। কিংবদন্তি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভাতিজা। অর্থাৎ রক্তের ভেতরেই যার সুস্থ সংগীত ও সুরের ধারা বহমান।
অসংখ্য জনপ্রিয় আর কালজয়ী গানের সুরকার তিনি। কয়েকটা গানের কথা উল্লেখ করাই যায়: সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ কিংবা ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’; এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও’ কিংবা ‘তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে’; শাম্মী আখতারের গাওয়া ‘ভালোবাসলে সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’; বেবী নাজনীনের গাওয়া ‘কাল সারারাত ছিল স্বপ্নের রাত’; পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’ ইত্যাদি। শেখ সাদী খানের সুর করা শুধু এরকম দারুণ জনপ্রিয় ও কালজয়ী তালিকা করলেও সেটি শত ছাড়িয়ে যাবে।
শেখ সাদী খান বেশ কিছু সিনেমারও সংগীত পরিচালক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন দুবার। তিনবার পেয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। তাকে নিয়ে কেন এত কথা?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল তাকে বাদ দিয়েছে। প্রায় ৯ বছর ধরে চলে আসা বিটিভির ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ অনুষ্ঠান থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। শেখ সাদী খানের অবর্তমানে অনুষ্ঠানের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। যিনি এই অনুষ্ঠানে সংগীত বিশ্লেষক হিসেবে শুরু করেছিলেন। অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ সাদী খান। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, শিল্পীদের অধিকার ও দাবি দাওয়া, বিটিভির নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলার অভিযোগে শেখ সাদী খানকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যম তাই বলছে।
শেখ সাদী খানকে বিটিভি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে অবশ্য আরও আগেই। গত মাসে সমকালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, “আমি ২০১৬ সাল থেকে পরিকল্পনা ও গবেষণা করছি। জানুয়ারি থেকে আমাকে অনুষ্ঠানটি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। শিল্পীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া, বিটিভির নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলছিলাম দীর্ঘদিন। ফলে বিটিভির অনেক কর্মকর্তাকে সরে যেতে হয়েছে। তবে আসল যারা কলকাঠি নাড়ছিলেন তারা রয়েছে গেছেন। ওই মানুষরাই আমাকে সরানোর কাজটি করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন: শিল্পীদের দাবি দাওয়ার কথা বলাই কী আমার অপরাধ ছিল? আমি তো কোনো দল করি না। আমাকে কেন বিরত রাখা হবে?”
তার আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি এই বিষয়ে আরেকটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: “স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ কেন একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে থাকবে? কোনো কোনো শিল্পী প্রতিদিন গান করছেন আবার কোনো কোনো শিল্পী ছয় মাস, এক বছর বেকার। এটা তো মানতে পারব না। আমার সংগীতের ক্যারিয়ার ৫৪ বছরের। প্রথম থেকেই আমি সত্যের পথে থেকেছি, এখনো থাকব। আমার হাত ধরে এ দেশে প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেছেন মান্না দে, আশা ভোঁসলে, কুমার শানুরা। আমি এখনো নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই ‘স্মৃতিময় গানগুলো’ অনুষ্ঠানটি দেখলে বুঝতে পারবেন মাহমুদুননবী, ফারুক আহমেদ, আব্দুল জব্বারের মতো শিল্পীদের গানগুলো এখনকার নতুন শিল্পীদের কণ্ঠে তুলে দিচ্ছি। আমি তো ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্য কাজ করছি। এটাতে কেউ বাধা দিলে প্রতিবাদ করবই।”
বাস্তবতা হলো, বিটিভিতে না থাকলে বা বিটিভির কোনো অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে শেখ সাদী খানের মতো মানুষের কিছু যায় আসে না। এই অনুষ্ঠান করে তিনি নিশ্চয়ই অনেক টাকাও উপার্জন করেন না। এই বয়সে তার যে অনেক চাহিদা তাও নয়। ব্যক্তিজীবনে সজ্জন এবং পরিমিতিবোধ মেনে চলা মানুষ হিসেবেই তিনি পরিচিত। বরং শেখ সাদী খানের মতো একজন মানুষ বিটিভি তো বটেই, যে কোনো টেলিভিশন বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানে সেটি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্যই সম্মানের।
কিন্তু দলবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিই যে দেশের নিয়ম ও স্বাভাবিক ঘটনা, সেই দেশে শেখ সাদী খানরা বেমানান— যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। শিল্পীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন কিংবা কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থাকেন। তেলবাজি করে এবং স্রোতে গা ভাসিয়ে অনেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারেন। নিচ্ছেনও। অতীতের সরকারের চামচামি ও তেলবাজি করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এখন বিরাট বিপ্লবী—উঠতে বসতে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও গালি দেন, এরকম লোকের সংখ্যা অগণিত। এবং সেটি সংবাদমাধ্যমসহ প্রতিটি সেক্টরেই দেখা যাচ্ছে।