কেন বাড়ছে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার

যুগান্তর ড. মাহফুজ পারভেজ প্রকাশিত: ০৯ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৫

উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার ইংরেজিতে মব জাস্টিস, মব রুল, মবোক্রেসি, ওখলোক্রেসি নামে পরিচিত; যা একদল উচ্ছৃঙ্খল মানুষের দ্বারা আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী কর্তৃত্ব ও দাপট কায়েম করাকে বোঝায়। সরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং শাসনব্যবস্থার শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আইন ও বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এ গোষ্ঠীবদ্ধ প্রবণতার মধ্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রত্যক্ষ ছাপ বিদ্যমান। সংখ্যা ও শক্তির জোরে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রথা, প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুনকে অবজ্ঞা করে সহিংস পন্থায় নিজের কার্যসিদ্ধি করা কিংবা প্রতিপক্ষকে নিধন বা নির্মূল করাই উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার বা মব জাস্টিস; যার সঙ্গে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সম্পর্ক বিপরীতমুখী।


খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালের কাছাকাছি সময়ের গ্রিক ইতিহাসবিদ পলিবিয়াস এ ধারণাটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি অ্যারিস্টটলের তিনটি শাসনব্যবস্থার আলোচনায় গণতন্ত্রের একটি অবক্ষয়িত রূপ হিসাবে প্রতিস্থাপন করে নতুন ধারণা ‘ওখলোক্রেসি’ ব্যবহার করেন। শব্দগতভাবে গণতন্ত্র হলো ‘জনগণের শাসন’, যা সাধারণ ইচ্ছার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। অন্যদিকে, ওখলোক্রেসি হলো ‘উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার’, যা রাজনৈতিক বিষয়ে একটি দূষিত ইচ্ছা, বিভ্রান্তি, অযৌক্তিকতা বলপ্রদর্শনের মাধ্যমে করতে সচেষ্ট হয় এবং সুশাসন ও আইনের বিপরীতে উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচারের নামে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চাপিয়ে দেয়। ওখলোক্রেসি শব্দটি অর্থ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘মব রুল’ বা ‘মবোক্রেসি’র সমার্থক, যা নতুন শব্দ হিসাবে ১৮ শতকে উদ্ভূত হয়েছিল, যেখানে ‘মব’ শব্দটি ‘জনসাধারণের ভিড়’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তখন ইংরেজ সমাজ অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ছিল এবং লন্ডন বা প্রাদেশিক শহরগুলোতে বিরক্ত মানুষের দ্বারা দাঙ্গার সৃষ্টি হতো। রানি অ্যানের শাসনকালে (১৭০২-১৭১৪) ‘মব’ বা উত্তেজিত জনতা কথাটি ব্যাপক প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব পায় তখন কোনো পুলিশ বাহিনী ও জনশৃঙ্খলা না থাকার কারণে।


ইউরোপ ক্রমশ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের দিকে ধাবিত হলেও উন্মত্ত জনতার তাণ্ডব বা মব জাস্টিস থেমে থাকেনি। ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থানে মব বিচার আরও বাড়ে। নাৎসি জার্মানিতে ১৯৩৮ সালে ‘ক্রিস্টালনাখট’ ছিল রাষ্ট্রসমর্থিত মব আক্রমণের একটি উদাহরণ, যেখানে প্রতিপক্ষের ব্যবসা, উপাসনালয় ও ব্যক্তিদের ওপর সহিংস আক্রমণ চালানো হয়। সর্বসাম্প্রতিককালেও মব জাস্টিস দেখা গেছে উন্নত বিশ্বসহ নানা দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের আক্রমণ বা জার্মানিতে রাজনীতিকদের প্রতি জনতার আক্রোশ সবই সহিংস মব জাস্টিসের উদাহরণ।



বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অভাব এবং জাতি ও গোষ্ঠীগত দাঙ্গার ক্রমবর্ধমান ধারায় জনউচ্ছৃঙ্খলতা আফ্রিকার দেশগুলোতে চরম আকার ধারণ করেছে; যাকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘মব জাস্টিসের আফ্রিকান সিনড্রোম’। যেমন, উগান্ডায় মব সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। একপর্যায়ে তা মারাত্মক আকারে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ২০১৩ সালে দেশটিতে উত্তেজিত মবের হাতে মৃত্যুর ঘটনা ৪২৬টি থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৭৪৬-এ। উগান্ডায় মব সহিংসতার সূচনা হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও বিচারব্যবস্থার প্রতি দেশটির জনগণের অনাস্থা থেকে। পরে তা সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করায় মব জাস্টিস প্রতিরোধে ২০১৯ সালের পর আলাদা একটি বিভাগ খুলতে হয়েছিল উগান্ডা সরকারকে। তাছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া ইত্যাদি দেশেও মব জাস্টিসের ঘটনা বেড়ে প্রাণঘাতী ও মারাত্মক আকার নিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০২২ সালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯৪টি বা প্রায় ৭ শতাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মব সহিংসতায়। নাইজেরিয়ায় ১০ বছরে অন্তত ৫৫৫টি মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে।


আফ্রিকার দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায়, বাজার বা ব্যস্ত সড়কের মতো জনাকীর্ণ এলাকাগুলোয় মব সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। মব সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে দেশগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে জনসাধারণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা হ্রাস পাওয়াকে দায়ী করা হয়। তাছাড়া ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে নানা কাল্পনিক ও বানোয়াট অভিযোগ তুলে অভিযুক্তদের মব সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রচুর নজির রয়েছে। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা আফ্রিকায় মব জাস্টিসের ঘটনা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।


দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খল গণবিচারের উদাহরণ লক্ষ করা যায় ভারতে; যেখানে ধর্মের নামে, জাত-পাত, বংশ ও কৌলীন্যের ছদ্মাবরণে প্রতিপক্ষকে নৃশংসভাবে হতাহত করা হয়। বিশেষত ধর্মীয় ও মতবাদের দিক থেকে যারা ভিন্নতা পোষণ করেন, তাদের নিধনের জন্য ধর্ম কিংবা উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের চেতনায় সংখ্যাগরিষ্ঠকে উত্তেজিত ও উন্মত্ত করে লেলিয়ে দেওয়া হয়। নিরীহ ও দুর্বল সংখ্যালঘু বা মাইনোরিটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধর্মান্ধ ও রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী গোষ্ঠীর মব জাস্টিসের কারণে ভারতের বহুত্ববাদী সমাজ, সংসদীয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভঙ্গুর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও