
জেলেনেস্কির অসহায় মুখাবয়ব এবং পরাশক্তি নির্ভরতা
ইউক্রেন সম্পর্কে মার্কিন নীতির আকস্মিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় যে সময় অর্থাৎ মাত্র দু-তিনদিন আগে সামরিকীকরণের উপর একটি শীর্ষ সম্মেলনের জন্য কেয়ার স্টারমার ইউরোপীয় এবং কানাডিয়ান নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ঠিক সেসময়ই ইসরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় সমস্ত মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন, যা ইসরাইল-গাজা দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধবিরতিকালীন সময় একটা হুমকিস্বরূপ।
গাজা সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান হল, গাজায় তিনি পুরো জনগোষ্ঠীর জাতিগত নির্মূলের আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে তা সমর্থন করা হয়নি। আর সেকারণেই ইংল্যান্ড কিংবা ইউরোপের সরকার প্রধানরা ট্রাম্প প্রশাসনের মন ভাঙ্গাতে ছুটে গেছেন ওয়াশিংটন। কিন্তু সরকার প্রধানদের ওয়াশিংটনে ছুটে গিয়ে এ সময় ইউক্রেনের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য অনুরোধ করতে খুব একটা সাহস দেখাতে পারেননি। অথচ ইউরোপের জন্য ইউক্রেনে স্বস্তি এবং স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। দৃশ্যত, পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ইউক্রেনের অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের চেয়ে অনেক বড় হুমকি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার এবং ফ্রান্সের ম্যাক্রোঁর ওয়াশিংটন সফর ব্যর্থ হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কানাডার পক্ষে ওকালতি করতে গেলে ওয়াশিংটনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন- ট্রাম্প বেআড়া মানুষের মত তাঁর কথা থামিয়ে বলেন 'দ্যাটস এনাফ' । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনেস্কিকে ট্রাম্প এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স রীতিমত অপমান করেছেন গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) । সত্যি কথা বলতে গেলে এটা একটা উন্নত দেশের প্রেসিডেন্ট সুলভ আচরণ ছিল না এ কথোপকথনে।
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে মিঃ জেলেনস্কি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের মধ্যে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝগড়া-বিরোধের পর এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনের ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ২ মার্চ একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেন, যেখানে ইউরোপীয় নেতারা, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান, ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট এবং ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতিরা উপস্থিত ছিলেন। সকলেই ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন। ইতিমধ্যে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটের মতো স্যার কিয়ার স্টারমার জেলেনস্কিকে ট্রাম্পের সাথে "বিষয়গুলি সমাধান" করার আহ্বানও জানিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওয়াশিংটন রাশিয়ার সাথে শত্রুতা জিইয়ে না রেখে বিশ্বব্যাপী আমেরীকা কিংবা পরাশক্তিগুলোর "সমকক্ষ প্রতিযোগী" চীনের উপর মনোনিবেশ করতে চায়; তাদের এখন স্বীকার করে নিতেই হচ্ছে যে, আটলান্টিক নয়, প্রশান্ত মহাসাগর এখন অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, এবং সেই অনুযায়ী ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের শ্রেণিবিন্যাসে ইউরোপকে খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখছে না। দৃশ্যত ইইউ বা ব্রিটিশ নেতাদের চেয়ে বরং ওয়াশিংটন ভালোভাবে উপলব্ধি করছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তারা হেরে যাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ব্যবসাটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে । সেজন্যই পুঁজিবাদী আমেরিকা নিমিষেই তার প্রয়োজনে যেন ইউক্রেনকে টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে মারতে চাইছে । মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন কোনও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে নয়, সব কিছুই হল বৈশ্বিক বাণিজ্যের নেতৃত্ব নেয়ার লড়াই ।
এদিকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি উল্লেখ করেছিলেন যে ইউক্রেন তীব্র জনবল সমস্যা বিরাজ করছে এবং স্থানীয়ভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও মনোবল হারিয়ে ফেলছে, এমনকি একধরনের জোর করেই তারা তরুনদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে আসছে । ব্রিটিশ মিডিয়াও (যেমন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস), কয়েক মাস ধরে এই বিষয়ে রিপোর্ট করেছে।