
সেনাপ্রধানের সতর্কবার্তা আসলে কাদের জন্য এবং কেন
জাতীয় শহীদ সেনা দিবস তথা পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের একটি বক্তব্য নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা আলোচনা হচ্ছে। তার বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের চেষ্টা চলছে যে তিনি আসলে কী বলতে চাইলেন এবং কী বার্তা দিলেন?
'নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ না করলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে' বলে তিনি আসলে কাদেরকে সতর্ক করলেন এবং নিজেদের বলতে কাদেরকে বোঝালেন? শুধু তার বাহিনীর লোকদের নাকি অন্যান্য বাহিনী, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষকেও সতর্ক করলেন?
কেন তিনি ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর হত্যার ঘটনাটি তৎকালীন বিডিআর সদস্যরাই ঘটিয়েছেন বলে জোর গলায় উচ্চারণ করে এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না বা 'এখানেই ফুলস্টপ' দিতে বললেন? কেন তাহলে এই ঘটনায় তদন্ত কমিশন গঠিত হলো—সেই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা না বলে কেন শুধু 'ড. ইউনূস' বলে সম্বোধন করলেন—তা নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সেনাপ্রধানের ওই বক্তব্যটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা সামরিক বাহিনীর কোনো কোনো সাবেক কর্মকর্তা এবং কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারও যখন নানাবিধ প্রশ্ন তুলছেন, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'সেনাপ্রধান আমার জন্য অনেক উঁচু স্তরের লোক। তিনি একটি বাহিনী চালাচ্ছেন। তিনি কোনো কথা না বুঝে বলেননি। এর ইন্টারপ্রিটেশন (ব্যাখ্যা) কী, আপনারা জানেন।' (প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
একটু পেছনে ফেরা যাক। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান মানুষকে সংঘাতের পথ এড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সমস্ত হত্যা, সমস্ত অন্যায়ের বিচার আমরা করব। আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন। আমি সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়েছি। আপনাদের জানমাল এবং আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি যে আপনারা আশাহত হবেন না।' (ডয়েচে ভেলে, ০৫ আগস্ট ২০২৪)
সেনাপ্রধানের এই দায়িত্ব গ্রহণ এবং এরপরে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনীর মাঠে থাকার পরেও দেশে যখন একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; ডাকাতি-খুন-ধর্ষণ-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বাড়ছে; পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও থামছে না; অপরাধ দমনে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করতে হয়েছে এবং সরকারের আইন উপদেষ্টাও বলছেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই; যখন ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি অব্যাহত রয়েছে; যখন নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সরকার ও তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে—সেরকম বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে ছয় মাস পরে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসের এক অনুষ্ঠানে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় দেশবাসীকে সতর্ক করে সেনাপ্রধান বলেন, 'আপনারা যদি হানাহানি বন্ধ না করেন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।'
সেনাপ্রধান যেদিন এই বক্তব্য দিলেন তার ঠিক আগের দিন তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্টে এক অনুষ্ঠানে সেনা সদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, 'যতদিন না একটা নির্বাচিত সরকার পাই, ততদিন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে।' কাজ করতে গিয়ে বলপ্রয়োগ করা যাবে না উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, 'মাঝে মাঝে কাজ করতে গিয়ে কিছু বলপ্রয়োগ হয়ে যায়। বলপ্রয়োগ করতে গেলেও অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে যেন হয় এবং যত কম বলপ্রয়োগ করা যায় ততই ভালো।'
এর পরদিন সেনাপ্রধানের পুরো বক্তব্যটি যারা দেখেছেন এবং শুনেছেন, তারা তার প্রতিটি বাক্য, শব্দ এবং তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তথা শরীরী ভাষা, অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তি যদি খেয়াল করে থাকেন তাহলে দেখবেন যে, তিনি বেশ ক্ষুব্ধ। গত প্রায় সাত মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যা যা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি যে খুব সন্তুষ্ট নন এবং অনেক বিষয় নিয়ে তিনি যে বিরক্ত, সেটি তার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট।