
বাংলাদেশে সংস্কার বাস্তবায়ন কঠিন কেন
একটি দেশের টেকসই অগ্রগতির জন্য ধারাবাহিক সংস্কার অপরিহার্য। যদিও বাংলাদেশ একটি ক্রমবিকাশমান অর্থনীতি, কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও সামাজিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা এখানে অত্যন্ত কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করেছিল। ফলে বাজারমুখী অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি হয়। তবে এর পর থেকে বড় ধরনের কোনো কাঠামোগত সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনৈতিক স্বার্থপরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নীতি-সংস্কারের প্রতি অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধতা সংস্কার বাস্তবায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যেমন ভিয়েতনাম, ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। অপর দিকে বাংলাদেশে সংস্কারপ্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই স্থবির হয়ে পড়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ নিবন্ধে বিশ্লেষণ করা হবে, কেন বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কঠিন এবং এর মূল বাধাগুলো কীভাবে দূর করা যেতে পারে।
সংস্কারের গুরুত্ব ও বহুমুখী দিক
সংস্কারের গুরুত্ব বহুমুখী, যা শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামগ্রিক রূপান্তরপ্রক্রিয়া, যা দেশের সামাজিক, প্রশাসনিক, বিচারিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সংস্কারপ্রক্রিয়াকে ব্যাপক পরিসরে গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হওয়ার পাশাপাশি সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
অর্থনৈতিক সংস্কার বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আগেই বলেছি, আশি ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটে, রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হয়। বিশেষ করে পোশাকশিল্পের উত্থান এবং বাণিজ্য উন্মুক্তকরণ নীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাব, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, কর আদায়ের সীমাবদ্ধতা ও ব্যবসাবান্ধব নীতির অভাবের কারণে নতুন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়েছে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং ও রাজস্বব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা জরুরি।
রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্বও কম নয়, কারণ গণতন্ত্রের বিকাশ, নির্বাচনব্যবস্থার স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা দেশ পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারবিমুখতা এ খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় এবং এর ফলে অন্যান্য খাতেও সংস্কার কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করা সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রমকে আরও জনবান্ধব করা সম্ভব। বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্বচ্ছতার অভাব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ব্যাহত করছে। তাই প্রশাসনিক কাঠামোতে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘসূত্রতা, মামলার জট, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বিচারব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জ। সাধারণ জনগণের জন্য দ্রুত বিচার ও আইনি সহায়তা সহজলভ্য করতে হলে যথাযথ নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক সংস্কার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, শ্রমবাজার সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে। মানবসম্পদের যথাযথ বিকাশের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি শ্রমবাজারে বৈষম্য কমানো এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।