
সেনাপ্রধানের গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই বক্তব্য রাখেন। সেগুলো সব সময় সমান তাৎপর্য বহন করে না। তবে মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের হেলমেট হলে ২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাৎবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে আয়োজিত জাতীয় শহীদ সেনা দিবসের অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য দিয়েছেন, নানা কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতানৈক্য, বিভেদ, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিভিন্ন গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, গুজব, বিভ্রান্তি– সব মিলিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও উদ্বেগ কাজ করছে। নানা কারণে অন্তর্বর্তী সরকারও দৃঢ়তা দেখাতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক শক্তি সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্য আলাদা তাৎপর্য বহন করছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, “হানাহানি না করে দিনশেষে দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে এক থাকতে হবে। যদি নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।” এই কথাগুলো বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত, তখন এই বিভেদ ও অস্থিরতা বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে পারে। তার এই বক্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নয়, বরং দেশের একজন নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে জাতিকে একত্র হওয়ার এবং সংঘাত এড়িয়ে চলার আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক সংকট থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতো।
সেনা দিবসে সেনাপ্রধানের দেওয়া ১৭ মিনিটের এই বক্তব্যকে অন্তবর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দল, মবভায়োলেন্সের হোতা, ক্ষমতাচ্যুত পক্ষ, এমনকি দেশের ভেতর ও বাইরের ইউটিউবারদের জন্য 'ম্যাসেজিং স্পিচ' হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। সেনাপ্রধান যে কথাগুলো আজ বলেছেন, তা আরও আগে বললে ভালো হতো। কিন্তু আজ তিনি স্পষ্ট ও নির্ভীকভাবে সেই কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি 'সহায়ক কোর্স' হিসেবে কাজ করতে পারে।
সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা, সাম্প্রতিক অস্থিরতা, এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, "আমি এই বর্বরতার চাক্ষুষ সাক্ষী।" তিনি পিলখানা ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই বর্বরতা কোনো সেনা সদস্য করেনি, বরং এটি তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল। তিনি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখেননি এবং বলেছেন, "ফুল স্টপ, এখানে কোনো ইফ এবং বাট নাই।" তার এই স্পষ্ট উচ্চারণ পিলখানা ট্র্যাজেডির সঠিক ইতিহাস ও এর বিচার সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করতে সাহায্য করবে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের দিনই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পিলখানায় বীর সেনাসদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর ধরে জাতি হিসেবে আমাদের নানা বিভ্রান্তিতে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই নির্মমতার সুবিচার নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। তিনি বলেছেন, "আমরা নিজেরাই এই সমস্ত জিনিস নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছি, এই জিনিসটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি, যা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।" পিলখানার হত্যাকাণ্ড নিয়ে যারা প্রতিদিন ‘মহাভারতের কাহিনি’ রচনা করছেন, চক্রান্ত খুঁজছেন, তাদের জন্য সেনা প্রধানের বক্তব্য নিঃসন্দেহে চপেটাঘাত।
সেনাপ্রধান আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণ হিসেবে বলেছেন, "আমরা নিজেরাই হানাহানি নিয়ে ব্যস্ত, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত।" তিনি সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সংস্থাগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। খারাপ কাজের পাশাপাশি অসংখ্য ভালো কাজও করেছে। আজ যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর ধরে স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এর পেছনে এই সশস্ত্রবাহিনীর বহু সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই সংস্থাগুলোকে কার্যকর রেখেছে।