
বইমেলার অর্থনীতি : বৈষম্য প্রেক্ষিত
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাসব্যাপী চলছে বইমেলা। মেলায় অংশ নেওয়া ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩৬টি। লিটলম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় করা হয়েছে। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু চত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
মেলার পুরো মাস জুড়ে এইসব স্টলে থাকে ভিড়। প্যাভিলিয়ন বা স্টলে ব্যস্ততা অঢেল, তড়িৎ চলাফেরা, হাঁক-ডাক, শোরগোল লেগেই থাকে। এর বাইরে ক্রেতা-পাঠকদের ভিড়, গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি তো আছেই। বই ব্যাগে ভরা হচ্ছে, টাকা দেওয়া হচ্ছে, রশিদ কাটা হচ্ছে—সব মিলিয়ে একটা দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার।
আশেপাশে অনেক স্টল সাজানো গোছানো। রংপুর থেকে এসেছে একটি প্রকাশনী সংস্থা। স্মিতহাস্যের এক যুবক বসে আছেন স্টলে। মাঝে মাঝে দুই একজন সেখানে আসছেন, দুই চারটা বই উল্টেপাল্টে দেখে চলে যাচ্ছেন। না, বই বিক্রি হচ্ছে না তেমন। কেউ বইগুলোর সামনে দাঁড়ালে বিক্রেতা যুবকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে—প্রত্যাশা করছেন যে, বই বিক্রি হতে পারে।
যে কেউ কোনো বই হাতে নিলে, সে যুবাটি বইটি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন। তাতে কিছুটা ফল হচ্ছে—কেউ কেউ দুই একটা বই কিনছেন বটে। কিন্তু তেমনটা নয়। ক্যাশবাক্সের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, সেখানে ক'টা একশ টাকার নোট ভিন্ন আর কিছুই নেই। 'এমন বিক্রি-বাট্টা হলে দোকানের ভাড়াই যে উঠবে না'—ভ্রু-কুঞ্চিত হয় বিক্রেতা যুবাটির।
ঠিক সে সময়েই আমি দাঁড়ালাম স্টলের সামনে। চোখ যায় একটি কবিতার বইয়ের দিকে। পকেট থেকে টাকা বের করি বইটি কেনার উদ্দেশে। কিনে নেই বইটি—তাকাই বিক্রেতা যুবকটির পরিতৃপ্ত মুখের দিকে।
সে স্টল থেকে কৌণিকভাবে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা পথ দিয়ে ক্লান্ত পায়ে চলছিলেন একজন। আটপৌরে শাড়ি পরা প্রৌঢ়া মহিলা, কাঁধে একটি ঝোলা, হাতে ধরা কটি বই—এমনভাবে ধরেছেন যেন সবাই দেখতে পায়। বোঝা গেল যে, হাতে ধরা বইটির লেখক তিনি নিজে। পাশ দিয়ে কেউ গেলেই মহিলা থামাচ্ছেন, এগিয়ে ধরছেন তার বইটি, অনুরোধ করছেন কিনতে।
উঁহু, এ পর্যন্ত কাউকেই সে বইটি কিনতে দেখা গেল না। কেউ তার অনুরোধের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন, কেউ কেউ অবশ্য মৃদু হেসে হাত নেড়ে তাদের অপারগতার কথা মহিলাকে জানাচ্ছেন। মুখোমুখি আমরা দুইজন থামি। মহিলাটি আমার সামনে তার বইটি তুলে ধরলে আমি বিনাবাক্যে সেটি কিনে নেই। খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ে আমাদের দুইজনের মুখেই—তিনি বিক্রি করতে পেরে এবং আমি কিনতে পেরে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অর্থনীতি
- বৈষম্য
- অমর একুশে বইমেলা