
একুশের চেতনা যুগে যুগে অনুপ্রেরণা জোগাবে
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী সরকারে পতনের মধ্য দিয়ে দেশ নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এমনই এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পালিত হতে যাচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি মানুষ এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছে, তা নয়। এ দিনটি বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বে মিশে আছে এবং থাকবে চিরদিন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়নি।
বাংলাদেশের মানুষের এ বিরল ত্যাগ ও বিসর্জনের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার জন্যই জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করে থাকে।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলা সংগত কারণেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা ভেবেছিল, পাকিস্তানের অধীনে তারা একটি সত্যিকার স্বাধীন দেশের নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দেশ ভাগের পর এ অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারে, পাকিস্তানের শাসন কাঠামোর আওতায় এদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার মোটেও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের মানুষের ওপর প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৮ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই। পাকিস্তানি শাসকচক্র সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে এ অঞ্চলের মানুষের ভাষার ওপর আক্রমণ চালায়। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
একমাত্র উর্দুই হবে সর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। কিন্তু সেই সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশই ছিল বাংলা ভাষাভাষী। অথচ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণে তাদের যুক্তিসংগত দাবি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। সেই সময় যদি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।
যা হোক, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ড. মো. শহীদুল্লাহসহ এদেশীয় বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। কিন্তু তাদের সেই যৌক্তিক দাবির প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি না দেখিয়ে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঘোষণা করে, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। পুলিশ কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে। এতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহিদ হন। আহত হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রাম করে।