
ছাত্রদের দল গঠন নিয়ে তোলপাড় রাজনীতির অঙ্গনে
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে এই দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি। জনমত জরিপের মধ্য দিয়ে আজই এই দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।’
ছাত্ররা যে একটি নতুন দল গঠন করতে যাচ্ছে, এটি বেশ কয়েক মাস ধরেই স্পষ্ট হচ্ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা না হলেও জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রম থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি যখন দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও থানায় কমিটি গঠন করতে শুরু করে এবং কবে কোথায় কোন জেলায়, কোন উপজেলায় কমিটি গঠিত হয়েছে, তা তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশও করে, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন ফেব্রুয়ারির শুরুতে জানান, তিন শতাধিক উপজেলায় ও বেশ কয়েকটি জেলায় জাতীয় নাগরিক কমিটির কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে।
এর পরপরই ৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দল গঠনের ঘোষণা আসে। ছাত্রদের এই দল গঠনের ঘোষণায় জনমনে বেশ কৌতূহল দেখা দিয়েছে। আর এ নিয়ে তোলপাড় রাজনৈতিক অঙ্গনে, যা আমাদের দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
আমাদের দেশের ইতিহাসে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গঠিত হয় মুসলিম লীগ, ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকার তৎকালীন অভিজাত এলাকা ওয়ারীর একটি বাড়িতে বসে ভারতবর্ষের মুসলিম রাজন্যবর্গ এই দল গঠন করেন। এর ৪৮ বছর পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে অত্যন্ত গোপনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তারপর পাকিস্তান আমলে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দল গঠিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণ আজাদী লীগ, জনতা পার্টি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, গণ সংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)সহ শতাধিক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। কিন্তু অতীতে একমাত্র জাসদ ছাড়া আর কোনো দল গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় হয়নি।
এ ছাড়া অতীতে পুরোপুরি তারুণ্যনির্ভর, শুধু ছাত্রদের নিয়ে, ছাত্রদের নেতৃত্বে কখনো কোনোকালে কোনো দল গঠিত হয়নি। খুব সম্ভবত এ কারণেই নতুন দল গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এত আলাপ-আলোচনা, এত উত্তাপ-উত্তেজনা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আলাপ-আলোচনা, উত্তাপ-উত্তেজনার আরেকটি কারণ সম্ভবত ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই দল গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে। তাদের আশঙ্কা, ছাত্রদের দল গঠনের নামে কিংস পার্টি না গঠিত হয়। এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। তা হলো অতীত অভিজ্ঞতা। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার শীর্ষ অবস্থানে অবস্থান করে ক্ষমতার সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা প্রয়োগ করে দল ভাঙিয়ে নতুন দল গঠনের অভিজ্ঞতা। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই চেষ্টা করা হয়। তাই অনেকে সেই আশঙ্কা করছে। তবে এই আশঙ্কার যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় আছে। কারণ ছাত্ররা যে প্রক্রিয়ায় নতুন দল গঠন করছে, তা অতীতের দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতীতে সমমনা কিছু ব্যক্তি বা রাজনৈতিক নেতা নিজেদের মধ্যে আলোচনা-বৈঠক করে দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নেমে সদস্য সংগ্রহ অভিযান করেন। তারপর দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন স্তরে দলের কমিটি গঠন করেন। সেই সঙ্গে অন্য দলের নেতাকর্মীদের নিজ দলে টেনে নিয়ে দলকে শক্তিশালী করেন। এটি মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জাসদ, জাতীয় পার্টি, জনতা পার্টি, বিএনপিসহ সবার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ সব রাজনৈতিক দল গঠিত হয় ওপরতলা থেকে। তারপর তা ক্রমাগত নিচের দিকে বিস্তৃত হয়। কিন্তু ছাত্রদের দল গঠন প্রক্রিয়া শুরুই হয়েছে তলার দিক থেকে থানা, উপজেলা, জেলা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে। তারচেয়েও বড় কথা, এই দল গঠিত হচ্ছে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী, অংশগ্রহণকারী সাহসী নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে, যাঁরা অভ্যুত্থানের সময় মাঠের লড়াকু পরীক্ষিত সৈনিক।
শুধু তা-ই নয়, জনমত জরিপের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এই দল গঠন। ৬ ফেব্রুয়ারি দল গঠনের ঘোষণার দিন থেকেই জনমত জরিপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে অনলাইনে। ‘আপনাদের চোখে নতুন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই জনমত জরিপের কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে ‘আপনার দল আপনি গঠন করবেন’ এই স্লোগানে। জনমত জরিপের জন্য অনলাইনে যে ফরম ছাড়া হয়েছে, সেই ফরমে মানুষের প্রত্যাশা জানতে চাওয়া হয়েছে।