
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের বিবেচ্য বিষয় যা হওয়া উচিত
সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও কর্মচারীদের নিয়োগের জন্য বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব পাচ্ছে এনটিআরসিএ। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। কেননা বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রধান ও কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই অনিয়মের অভিযোগ উঠে থাকে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। তাই আজকের আলোচনাটি এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখছি।
যেকোনো কারণে শিক্ষক অযোগ্য হলে দীর্ঘমেয়াদি অপূরণীয় ক্ষতি হয় দেশ ও জাতির। একজন অযোগ্য শিক্ষক তার শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান অযোগ্য হলে, অসৎ হলে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় সেই ক্ষতির পরিমাণ। কর্মরত শিক্ষকগণ ও পরিচালনা কমিটির সদস্যগণ সুযোগ্য হলে, ভালো হলে যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠানের সফলতা। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সুযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রধানই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা। শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করেন শিক্ষার সার্বিক সুন্দর পরিবেশ। বিভিন্ন মুখি সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের করে তোলেন মননশীল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত প্রদান করেন উদ্দীপনা, বৃদ্ধি করেন কর্ম উদ্যম, নিশ্চিত করেন সফলতা।
শিক্ষার্থীদের প্রদান করেন নৈতিক, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা। গড়ে তোলেন ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে শুভ সম্পর্ক। সুশিক্ষার পাশাপাশি নিশ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এছাড়াও একজন ভাল প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রতিনিয়ত করে থাকেন আরও অনেক অনেক শুভ কাজ। এককথায় জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করতে হয় একজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে। তাই তাঁর থাকতে হয় নানামুখী যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা; যা তালিকা করে শেষ করা অসম্ভব। অর্থাৎ অত্যন্ত সমৃদ্ধ থাকতে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। তাইতো বলা হয়ে থাকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান যেমন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেমন। এ কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান, ধরন, অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে যথাযোগ্য প্রধান বাছাই করা অত্যন্ত দায়িত্বশীল কঠিন কাজ। যারা বাছাই করবেন তাদেরও থাকতে হবে ততোধিক উন্নত জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সততা, নিরপেক্ষতা ও দূরদর্শিতা।
কেবল অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ও অভিজ্ঞতা দেখে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে কাউকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান করার যোগ্যতা পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। শুধু এ সকল দিক বিবেচনা করে কাউকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভেবে দেখার বিষয়। যার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভালো, যিনি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর পান তিনি জ্ঞানের মূল্যায়নে অবশ্যই এগিয়ে থাকবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, জ্ঞান হচ্ছে কারো যোগ্যতা মূল্যায়নের একটি মাত্র মাপকাঠি। তাই প্রচলিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কাউকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করা উচিত নয়। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে অধিক নম্বরের অপ্রাসঙ্গিক ও অতিজাটিল প্রশ্নে নেওয়া হয় এসব লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা।
আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবার যোগ্যতার মাপকাঠি আরো অনেক বিস্তৃত। তাই প্রার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ মূল্যায়ন প্রয়োজন। এটি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটি জটিল প্রশাসনিক পদ। এই পদে প্রশাসন থেকে ব্যবস্থাপনাই বেশি। এইরূপ নির্বাহী পদে অধিক পাকা/ পরিপক্ব লোক নিয়োগের জন্য বাছাই প্রক্রিয়ায় হাতে লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব অনভিজ্ঞ এন্ট্রি পোস্টের তুলনায় অনেক কম। ব্যাংক-বীমাসহ দেশি-বিদেশি অধিকাংশ আর্থিক/ অনার্থিক প্রতিষ্ঠানেই নির্বাহী/ উচ্চপদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত বিবেচনা করে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কলমের জোরের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক জ্ঞান, মনোবৈজ্ঞানিক জ্ঞান, বাস্তব অভিজ্ঞতা, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগানোর ক্ষমতা, মানবীয় গুণাবলি, ন্যায় পরায়ণতা ও সৎ সাহস থাকা অত্যাবশ্যক।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিখ্যাত ও সুযোগ্য হলে তাঁকে নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক গর্বিত হয়। তাঁর কারণে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীরা বিখ্যাত ও সুযোগ্য হবার স্বপ্ন দেখে। কর্মে, কথায়, ধর্মে, জ্ঞানে তিনি হবেন সকল মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। শিক্ষার্থীদের জন্য হবেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আপন মানুষ। তাই কাউকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান করার আগে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান, মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, নৈতিক চরিত্র, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম, ইত্যাদিসহ দীর্ঘ অতীত জীবনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া খুব জরুরি। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রদত্ত নেতৃত্ব ও অর্জিত কৃতিত্বসহ ভালোভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তাঁর পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত। নেওয়া উচিত প্রার্থীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার (দমবন্ধ মৌখিক পরীক্ষা নয়)। উন্নত বিশ্বে অন-লাইনেও হয়ে থাকে সেই সাক্ষাৎকার। গুগল বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও নেওয়া হয় প্রার্থী সম্পর্কিত তথ্যাদি।