
কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়
নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু প্রতিহিংসা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে স্বীকার করে, অপরাধীদের দায় স্বীকার করিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এ কারণেই তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেছিলেন, যা অতীতের অপরাধ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে পুনর্মিলন ও পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু এর পরপরই জাতি গভীর বিভাজনের শিকার হয়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর নানা রকম আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে স্থায়ী কোনো রূপ নিতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড, এরপর সামরিক শাসনের দীর্ঘ সময়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী শাসন, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরা কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসর, যারা নিজ জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই অপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়া জাতির বিভাজনকে বাড়িয়ে দেয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শাসনব্যবস্থা