সহিংসতা আমাদের ভাষা হয়ে গেছে
ড. সেলিম জাহান। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের নীতির সীমাবদ্ধতা, তরুণদের হতাশা ও সম্ভাবনা, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ও বহুমাত্রিক বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ নিয়ে।
ভাগ্য ফেরাতে আমাদের তরুণেরা বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। আমাদের মানব উন্নয়ন ভাবনায় তরুণেরা কেন উপেক্ষিত?
সেলিম জাহান: আপনার এই প্রশ্নটা আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কারণ, আমরা যখন মানব উন্নয়নের কথা বলছি, তখন সার্বিকভাবে একটা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা বলছি। কিন্তু এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, মানব উন্নয়ন শুধু বর্তমানের নয়, মানব উন্নয়ন ভবিষ্যতের। তরুণেরা হচ্ছে সেই ভবিষ্যৎ।
এ দিক বিবেচনায় তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের প্রত্যাশা, তাদের সম্ভাবনা, তাদের সক্ষমতা—এ বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যতটা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার, ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
যখন সংগ্রাম, আন্দোলনের কথা আসে, যখন দেশবদলের কথা আসে, তখন আমরা তরুণদের সামনে আনি, কিন্তু সংগ্রাম-আন্দোলন শেষে যখন প্রার্থিত ফল এসে যায়, তখন তরুণেরা উপেক্ষিত থেকে যায়।
নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে, সেটা জেনেও তরুণদের একটা অংশ কেন দেশ ছাড়তে এমন মরিয়া?
সেলিম জাহান: এর দুই রকমের কারণ আছে।
এক. অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলা হয় চাহিদার কারণ এবং চাহিদার কারণে সৃষ্ট সংকট। আমাদের তরুণেরা কখনোই বিপজ্জনক পথে ঝুঁকি নিয়ে যেত না, যদি রাষ্ট্র তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারত।
দুই. সব মানুষের মধ্যেই একটা উন্নত জীবন, একটা ভালো জীবন, একটা সম্ভাবনাময় জীবনে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। তরুণেরা যখন দেখে তাদের দেশের বাইরে সেই সুযোগগুলো আছে, অন্যান্য দেশের তরুণেরা সেই সুযোগগুলো নিচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা সেই দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তাদের যদি ঝুঁকি নিতে হয়, তাদের প্রাণ হাতে করে সুযোগগুলো নিতে হয়, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এখানেই রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈশ্বিক মণ্ডলে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের তরুণদের যে সম্ভাবনা আছে, অন্যান্য দেশ তার সুযোগ কীভাবে তৈরি করে দিতে পারে, তার একটা পথ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বের করা দরকার।
মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো ব্যাপারগুলোকে অনেকে এনজিওর ভাবনা বলে মনে করেন। অনেকে বলেন, এগুলো অনেকটাই নীতিনির্ধারকদের আলোচনার বিষয়। কিন্তু জরুরি এই বিষয়গুলো এত দিনেও কেন সাধারণ মানুষের ভাবনায় পরিণত হতে পারল না?
সেলিম জাহান: নীতিনির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন এবং নীতি বাস্তবায়নে মানুষ যদি তাদের প্রত্যাশার জায়গাটা খুঁজে পেত, তাহলেই এই ভাবনাগুলোকে তারা নিজেদের ভাবনা বলে মনে করতে পারত। আমরা যখন মানব উন্নয়নের কথা বলছি, তখন সেটাকে আমাদের পরিকল্পনায়, আমাদের বাজেটে এমন বায়বীয়ভাবে উপস্থাপন করছি যে তার সঙ্গে মানুষ ঠিক যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। যেমন মানব উন্নয়নের কথা এলেই মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানুষের সম্পদের প্রসার—এসব কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু আমরা যদি সোজাসুজিভাবে বলি, মানবসম্পদ উন্নয়নের মানে হচ্ছে মানুষের কর্মনিয়োজনের সুযোগ দিতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে, তাহলে এগুলো মানুষের বোধগম্য বিষয় হতো। এই সোজাসুজি বিষয়গুলো আমাদের বাজেটে, আমাদের পরিকল্পনায় উঠে আসছে না।
দারিদ্র্য দূরীকরণের জায়গাতেও দেখছি, আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা রয়েছে। সেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সম্পদ আহরণের কথা বলা হয়েছে, সম্পদ বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য শুধু একটা তাত্ত্বিক বিষয় নয়। যে মানুষটা দরিদ্র, যে মানুষটা প্রান্তিক, তাঁর যাপিত জীবনের প্রতিটি ঘণ্টায় তিনি দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। সুতরাং দারিদ্র্য দূরীকরণের যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলোকে যদি মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানুষ সেটার সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুঁজে পাবেন। যেমন আমরা যদি কৃষককে সার, বীজ, সেচের সুবিধা দিই; গ্রামীণ শিল্পে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের যদি সরকারি সহায়তা দিই, তখন মানুষ কিন্তু বুঝতে পারবেন দারিদ্র্য দূরীকরণ বিষয়টা শুধু কথার কথা নয়।
বেসরকারি সংগঠনগুলো মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণের যে প্রক্রিয়া, তারাও একটা অংশীদার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুপেয় পানি, কর্মনিয়োজন, নারীর ক্ষমতায়নে এনজিওগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। আমাদের এখানে সরকারি কাজকর্মে আমলাতান্ত্রিকতা আছে, আর সেটা সামষ্টিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। এর বিপরীতে এনজিওগুলো মাঠপর্যায়ে কাজ করছে, সে কারণেই এগুলোকে এনজিওর কাজ হিসেবেই সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে।