মার্কিন-ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঐক্য
গালভরা হাসি নিয়ে ফিলিস্তিন নিয়ে একটি নারকীয় ফন্দি আঁটতে দেখা গেল দুজনকে। গত ৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। দু-জনের একজন আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, অন্যজন বহু যুদ্ধের পেছনের কলকাঠি নাড়া দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শান্তিবাদী মুখোশপরা ডনাল্ড ট্রাম্প। গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি চুক্তির রহস্যটা এবার বোঝা গেল। নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের গোপন বার্তা ছিল, পনের মাসে সে যা করেছে তা অসাধারণ, এবার পথ ছেড়ে ট্রাম্পকে বাকি কাজটা শেষ করতে দেওয়া হোক! তাদের এই ক্রুর হাসির সঙ্গে প্রকাশ হলো সেই নতুন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা— ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র দখল করবে গাজা। মিসর ও জর্ডানকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ফিলিস্তিনিদেরকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। ট্রাম্পের কোম্পানি ও তার জামাই মিলে সেখানে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা জমাবে। তারা সুরম্য সব অট্টালিকা বানিয়ে বিক্রি করবে ইসরায়েলি দখলদারদের কাছে! গাজা ও পশ্চিম তীরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার এমন পরিকল্পনাই প্রকাশ করেছে এই ফ্যাসিস্ট যুগল।
মনে রাখা প্রয়োজন, ইসরায়েলের একার নয়, গাজায় গণহত্যার দায় যুক্তরাষ্ট্রেরও। ইসরায়েলি দখলদারি মতাদর্শ জায়নবাদও একা ইসরায়েলের নয়, এটি একটি ইউরোপিয়ান প্রোডাক্ট। ফিলিস্তিন তাই কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি অধিকৃত, লুণ্ঠিত ও রক্তাক্ত ভূখণ্ড মাত্র নয়— ফিলিস্তিন বৈশ্বিক মানবতা ও ঐক্যের আরেক নাম।
জায়নবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। যে কোনো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আজকের দুনিয়ার এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক-আদর্শিক দৈত্য। ভারতে বিজেপি-চর্চিত হিন্দুত্ববাদও ইসরায়েলি জায়নবাদের মতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। এ দুটি রাজনৈতিক আদর্শই দুটি ধর্মের মধ্যকার মানবতাবাদী, কল্যাণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দিকগুলো ছুঁড়ে ফেলে ধর্ম দুটিকে ছিনতাই করেছে সন্ত্রাসবাদী ও সম্প্রসারণবাদী পুঁজির সেবায় ও স্বার্থে। ইসরায়েলি জায়নবাদ আরও ভয়ানক— হিটলারের হাতে হলোকাস্টের শিকার একটি জনগোষ্ঠী নিজেরাই এক হত্যাযজ্ঞ শুরু করল। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এটাই তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও জন্মগত সত্য।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সৃষ্টি এক রকম পশ্চিমা অপরাধবোধ থেকে— পশ্চিমাদের উপহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের নাৎসি ও ফ্যাসিবাদীদের হাতে হলোকাস্টের শিকার না হলে ফিলিস্তিন টুকরো করে ইসরায়েল সৃষ্টি করা সম্ভব হতো না। ইসরায়েলের জন্ম একটি ইউরোপিয়ান দখলদারি ঔপনিবেশিক প্রকল্প হিসেবে। ইহুদি বংশোদ্ভূত খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ইলান পাপের কথায়, “বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বেশিরভাগ জায়নবাদী নেতা জাতিগত পুনরুজ্জীবনকে যুক্ত করেছে ফিলিস্তিনের উপনিবেশিকরণের সঙ্গে।”
নূর মাসালহা ফিলিস্তিনি ইতিহাসের চার হাজার বছর নিয়ে লেখা বইতে লিখেছেন, “জায়নবাদী দখলদারি ঔপনিবেশিকতার শিকড় ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদের গভীরে নিহিত। ... উনবিংশ শতকের শেষ দিকে যখন সব ইহুদিদের জড়ো করে ফিলিস্তিনে দখলদার-উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্য ঠিক হলো, ফিলিস্তিনে যে মানুষ বাস করে তা বেমালুম ভুলে গেল তারা। ১৮৯৭ সালে রাজনৈতিক জায়নবাদের যাত্রা শুরুর সময় প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে গৃহীত বাসেল কর্মসূচিতে ফিলিস্তিনের মাটিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের কোনো উল্লেখই করা হয় না।” যে দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদের ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সংঘটিত বর্ণবাদের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ইউরোপ হারাতে থাকে তার উপনিবেশগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক, সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের মাধ্যমে তার দখলদারি প্রকল্পটি কেবল বজায় থাকে না, শক্তিতে তা বাড়তেই থাকে। যা সম্ভব করেছে পৃথিবীতে একমাত্র সরাসরি সম্প্রচারিত বর্তমানের এই গণহত্যাযজ্ঞ। গাজায় আপাতত যুদ্ধবিরতি চললেও সেখানে শান্তি অনিশ্চিত। কারণ এতে যত না ট্রাম্পিয়ান নাটকীয়তা আছে, জায়নবাদীদের কাছ থেকে আন্তরিকতা ওই তুলনায় খুবই কম।