ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখুন
বর্তমানকালের পরিপ্রেক্ষিতে নয়া ইতিহাস তৈরির বাহানা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি। বর্তমানে যেভাবে কোনো কোনো মহল থেকে নিজের পছন্দমতো ইতিহাসের ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কখনো কখনো তা অতি হাস্যকর হলেও ডিজিটাল যুগে সেই প্রচারণায় অনেকেই মজে যায়। তা বিশ্বাস করে নেয়। মানুষ যাচাই করে দেখে না, এই প্রচারণাগুলোর কোনো ভিত্তি আছে কি না। ফলে জাতির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা পর্যায় নিয়ে নতুন যে ভাষ্যগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হবে ভবিষ্যতে, সেসব বিষয়েও আলোচনা করতে হবে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। সেই সঙ্গে আলোচনায় আসতে হবে, আসলে ভাষা আন্দোলনকে কি সত্যিই আমরা বুকে ধারণ করতে পেরেছি? যে তারুণ্যের হাতে ইতিহাস রক্ষার দায়, তারা আদতে সস্তা কোনো প্রচারণায় দিগ্ভ্রান্ত হবে না তো?
রাজনীতিতে সামগ্রিক অরাজকতার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন হয়েছিল, সংস্কারের মাধ্যমে তা একটি পরিণতির দিকে পৌঁছাবে— এমন আশায় বুক বেঁধেছিল দেশের জনগণ। কিন্তু বেশ কিছু কারণে সেই মোকামে পৌঁছানো যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তার একটি হলো, আমাদের ইতিহাস নিয়ে নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ইতিহাসকে নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা করতে দেওয়া হয়নি। যিনি যেখানে সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাঁকে সেই সম্মান দেওয়া হয়নি। ইতিহাসকে ইতিহাসের মতোই চলতে দেওয়া সংগত। কিন্তু কারণে-অকারণে বঙ্গবন্ধুকে সব কৃতিত্ব দেওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল আওয়ামী রাজনীতিতে, তা মোটেই সত্যনিষ্ঠ ছিল না। কিন্তু একাত্তর থেকে বঙ্গবন্ধুকে হটিয়ে দেওয়ার যে বালসুলভ প্রবণতা দেখা গেছে, তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ কি খুঁজে পাওয়া যায়?
অন্যদের অবজ্ঞা করার মতো আওয়ামী লীগের অগ্রহণযোগ্য প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে একশ্রেণির দিগ্ভ্রান্ত মতলববাজ, তার যে কোনো ভিত্তি নেই কিংবা কোথাও কোথাও ভিত্তি থাকলেও তা যে খুবই নড়বড়ে, সে কথাগুলোও নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। শেখ মুজিবের কথা বলতে হলে অন্যদের কথাও বলতে হবে, সেটা যেমন ঠিক, তেমনি অন্যদের অবদান শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের সমান করার অপচেষ্টাও নিন্দার্হ। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় সময় হলো আটচল্লিশ থেকে একাত্তর সাল। এই সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেও ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালের গণজাগরণ ও গণসচেতনতার মূল স্থপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা অগ্রাহ্য করে কি ইতিহাস রচনা করা যাবে? যাঁরা ইতিহাস রচনা করবেন, তাদের নির্মোহ হয়েই তা রচনা করতে হবে। যাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন, তাঁরাও সংযত হয়ে কথা বলবেন, সেটাই কাম্য।
প্রধানত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক নতুন ন্যারেটিভ তৈরির পাঁয়তারা চলছে। সেই ন্যারেটিভে আমাদের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন, আমাদের স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে পুরো জাতির দাঁড়িয়ে যাওয়াকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একদল মানুষ তো ১৯৭১ সালকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি মামুলি সংঘর্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছিল। কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নগুলো তুলল, তখনো দেশের সাধারণ জনতা জানত না যে এই আন্দোলন ‘মেটিকুলাস’ চিন্তার ফসল এবং সমন্বয়কদের প্রায় ২০০ সদস্যের মধ্যে শতাধিক সদস্যকে যখন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সদস্য বলে গর্ব করে বলা হতে লাগল, তখনই বোঝা গেল এখন এমন কিছু ঘটনা ঘটতে থাকবে, যেগুলোর সঙ্গে স্বাধীনতার স্পৃহার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং আমাদের এই মহান অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অনৈতিক চেষ্টা চলবে।
এসব প্রশ্ন নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর আলোচনা হওয়া দরকার। এখানে শুধু বলে রাখি, তরুণ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি কারও কারও সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তাদের অনেকের মুখেই হতাশার চিহ্ন দেখি। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য সম্পর্কে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়েই যে এই হতাশা, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। জাতি গঠনে তরুণদের মনে আশার আলো জ্বালিয়ে দেওয়া সবার জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। কোন পথে তা আসবে, সেটা ভেবে দেখতে হবে।
২.
জাতি পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করার ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন বিশাল বড় ভূমিকা রেখেছিল। এখন পঞ্চাশের সেই গৌরবের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে জাতি পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ইতিহাস রচিত হয়েছিল তখন। মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অগ্রাহ্য করে তার ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে তোলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল পূর্ববঙ্গের জনগণ। সেই রুখে দাঁড়ানোর মাধ্যমেই জেগে উঠেছিল স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা।
১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় বাংলায় যে বিশাল জনসমর্থন পেয়েছিল মুসলিম লীগ, তা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একেবারেই শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছায়। ১৯৪৮ সালেই ভাষার প্রশ্নে যে ছোট্ট দীপশিখা জ্বলে উঠেছিল, সেটাই ক্রমে অগ্নিকুণ্ডে রূপ নেয়।