চীনের বসন্ত উৎসব ও সর্পবর্ষ
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক দেশেরই নিজস্ব ক্যালেন্ডারও রয়েছে। বাংলাদেশে আছে বাংলা ক্যালেন্ডার, শহরাঞ্চলে যার ব্যবহার পয়লা বৈশাখ ও পয়লা ফাল্গুনেই বলতে গেলে সীমাবদ্ধ। তবে, গ্রামাঞ্চলে এখনও বাংলা সন-তারিখ কমবেশি প্রচলিত। বিশেষ করে, কৃষকদের অনেকেই বাংলা সন-তারিখের খবর রাখেন। চীনের ক্ষেত্রেও বলতে গেলে একই কথা প্রযোজ্য। চীনে শহরাঞ্চলগুলো সারাবছরই চলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণ মেনে। উৎসব-পার্বণেই কেবল স্থানীয় ক্যালেন্ডারের খোঁজ পড়ে। গ্রামের কথা আলাদা। সেখানে এখনও স্থানীয় ক্যালেন্ডারের কদর তুলনামূলকভাবে বেশি।
বাংলাদেশে বাংলা সন-তারিখ এখন নির্দিষ্ট। আগে পয়লা বৈশাখের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট ছিল না। কোনো বছর ১৩ই এপ্রিল, কোনো বছর ১৪ই এপ্রিল, কোনো বছর ১৫ই এপ্রিল আসতো পয়লা বৈশাখ। কিন্তু এখন নিয়ম করে প্রতিবছর ১৪ই এপ্রিলই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ আসে। কিন্তু চীনের নিজস্ব ক্যালেন্ডার চাঁদনির্ভর। চীনা নববর্ষের প্রথম দিনটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দিনক্ষণ মেনে চলে না। সাধারণত জানুয়ারির ২১ তারিখ থেকে ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যেই পড়ে চীনা নববর্ষের প্রথম দিনটি।
চীনা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি সিয়া রাজবংশ আমলে। তাই এ ক্যালেন্ডারের নাম ‘সিয়া ক্যালেন্ডার’। কৃষিকাজে ও উৎসব-পার্বণে এ ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। এ ক্যালেন্ডারের এক-একটি বছর বিভিন্ন মাসে নয়, বরং ২৪টি সৌরপর্যায় বা সৌরপদে বিভক্ত। প্রথম সৌরপদের নাম ‘লি ছুন’, যার অর্থ ‘বসন্তের শুরু’; আর শেষ সৌরপদের নাম ‘তা হান’, যার অর্থ ‘বড় শীত’। মাঝখানে আছে এমন আরও ২২টি সৌরপদ। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। তবে, এ কথা গ্রামাঞ্চলের জন্যই বেশি করে প্রযোজ্য।
‘সিয়া ক্যালেন্ডার’ অনুসারে আজ (২৯ জানুয়ারি, ২০২৫) নতুন বছরের প্রথম দিন। অন্যভাবে বললে, আজ চীনের বসন্ত উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ উৎসব স্থায়ী হয় নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে, বৈশাখ হচ্ছে প্রথম মাস। আর চীনা ক্যালেন্ডার অনুসারে, ‘বসন্ত’ হচ্ছে বছরের প্রথম ঋতু। বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু আছে, বসন্ত যার একটি। কিন্তু চীনে আছে মাত্র ৪টি ঋতু: বসন্ত (ছুন থিয়েন), গ্রীষ্ম (সিয়া থিয়েন), শরৎ (ছিউ থিয়েন), শীত (তুং থিয়েন)।
আমরা পয়লা বৈশাখ পালনের মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিই। কিন্তু পয়লা বৈশাখ আমাদের মূল উৎসব নয়। কিন্তু চীনের মানুষ চীনা ক্যালেন্ডারের প্রথম বছরের প্রথম দিনটি পালন করে ‘বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। এ উৎসব চীনাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। বসন্ত উৎসবকে চীনা ভাষায় বলা হয় ‘ছুন চিয়ে’; আর এ উৎসব উদ্যাপনকে বলা হয় ‘কুও নিয়েন’। আমরা যেমন নববর্ষের শুরুতে একে অপরকে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে স্বাগত জানাই, তেমনি চীনারাও একে অপরকে স্বাগত জানায়, শুভেচ্ছা জানায়। তবে, তাদের শুভেচ্ছা জানানোর ভাষা ভিন্ন। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা একে অপরকে ‘কুও নিয়েন হাও’ (শুভ বসন্ত উৎসব) ও ‘কুং সি ফা ছাই’ (নতুন বছরে বেশি বেশি অর্থ আসুক) বলে শুভেচ্ছা জানায়।
চীনারা বসন্ত উৎসব পালন করে বেশ ধুমধাম করে। ঈদের সময় বাংলাদেশে যেমন শহর থেকে গ্রামমুখী মানুষের ঢল নামে, তেমনি চীনেও বসন্ত উৎসবের সময় কোটি কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়। কারণ, বসন্ত উৎসবের মূল চেতনা হচ্ছে, পরিবারের সকল সদস্যের একত্র হওয়া।
ঈদের সময় বাংলাদেশে সালামির প্রচলন আছে। ছোটরা বড়দের সালাম করে সালামি পায়। চীনেও বসন্ত উৎসবের সময় ছোটরা বড়দের কাছ থেকে লাল খামে টাকা পায়। বসন্ত উৎসবের সময় চীনারা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার খায়, নতুন পোশাক পরে, ঘরের দরজায় শুভ কামনা লেখা রঙিন কাগজ ও ছবি ঝুলায়, ডাম্পলিং নামক এক ধরনের বিশেষ খাবার খায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বসন্ত উৎসব