দেশের রাজনীতিতে এক-এগারোর গন্ধ?
ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মইনুল হোসেন সবশেষ আলোচনায় এসেছিলেন জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময়। মৃত্যুর সাত মাস পরে পুলিশ তাকে ধরতে বা তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বারিধারার বাসায় গিয়েছিল— এরকম একটি সংবাদ নিয়ে তখন বেশ তোলপাড় শুরু হয়— যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানানজন নানা রকম রসিকতাও করেছেন।
‘আউট স্পোকেন’ হিসেবে খ্যাত ব্যারিস্টার মইনুল বহুবিধ কারণেই আলোচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে যখন সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে ‘বাকশাল’ নামে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়, তখন হাতেগোণা যে দু-চারজন মানুষ প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিলেন, মইনুল তাদের অন্যতম।
মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন: “যারা বাকশালের পক্ষে বলেন তাদের যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি যাই করেন সেটাই ভালো, যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক এবং যা বলেন, সেটাই শেষ কথা’ ইত্যাদি। কাজেই পক্ষে বলাটা খুবই সহজ। কিন্তু এর মধ্যে নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ গোপনে আলাপ-আলোচনা করে সাব্যস্ত করেন যে, বাকশাল কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যাবে না। সে হিসেবে সভায় জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও নূরে আলম সিদ্দিকী অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করলেন।” (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিন কাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১৫৩)।
বস্তুত এরপরে মইনুল হোসেন আর সেভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। দীর্ঘদিন পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যখন ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়, তখন তিনি এই সরকারের আইন ও তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পান।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেমন ‘সংস্কার’ শব্দটি খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলেও শব্দটি ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হচ্ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কার এবং ওই সংস্কারের অংশ হিসেবে তখন মাইনাস টু (হাসিনা-খালেদা) ফর্মুলা নিয়েও বেশ আলোচনা হয় এবং এক-এগারোর সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় অভিযোগ হলো তারা দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বইতে মইনুল হোসেন লিখেছেন: “মাইনাস টু ফর্মুলা আমাদের সময়ের অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয় ছিল। কিন্তু মাইনাস টু ফর্মুলা আমাদের কোন ফর্মুলা বলিয়া আমি বা আমরা কখনও দাবি করি নাই। তবে ইহা সত্য যে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রেক্ষাপটে দুই প্রধান দলের দুই নেত্রীর কি ভূমিকা হইবে তাহা নিয়া অনেকের নিকট হইতে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ আসিয়াছে। রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়া তখন কম-বেশী সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা একত্রে বসিয়া কোন রাজনৈতিক সমস্যা নিয়া আলোচনা করিতে পারিবেন না, বিদেশীদের ছোটাছুটি করিতে হইবে আমাদের দলীয় রাজনীতির বিভেদ দূরীকরণের জন্য— এই ধরনের পরিস্থিতি সঠিক রাজনীতির কথা হইতে পারে না। এই ধরনের উপলদ্ধি আমারও ছিল। যে কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে আমি বহুদিন হইতেই উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছিলাম।” (মইনুল হোসেন, গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি, সিটি পাবলিশিং হাউজ/২০০৯, পৃ. ৪৮)। দেশের রাজনীতিতে ফের ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারো শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে সম্প্রতি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে এক-এগারোর প্রসঙ্গ টেনেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তারপর এ নিয়ে চলছে কথার লড়াই। সত্যিই কি রাজনীতিতে এক-এগারোর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে?
এক-এগারো কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, সেটিকেই সংক্ষেপে ওয়ান ইলেভেন বা এক-এগারোরর সরকার বলে অভিহিত করা হয়। এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আরও তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০১, ১৯৯৬, ১৯৯১) দায়িত্ব পালন করলেও সেসব সরকারের এরকম কোনো বিশেষণ দেয়া হয় না। কারণ ওই সরকারগুলো নির্ধারিত তিন মাস সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি সাংবিধানিকভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও এটি নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারেনি। তারা দুই বছর সময় নিয়েছে— যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে ভোটার তালিকা তৈরি এবং রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার। কিন্তু নানা কারণেই এই সরকার বিতর্কিত হয় এবং ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে তাদেরকে এক-এগারোর সরকার বলে অভিহিত করা হয় মূলত নেতিবাচক অর্থে। যে কারণে ‘এক-এগারোর কুশীলব’ শব্দটিও রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করতে থাকেন। তারা এই সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।