সংকটাপন্ন অর্থনীতি, বিপর্যস্ত জনজীবন
বিশ্বব্যাংক প্রতি বছর Global Economics prospects নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য বিশ্ব অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রকাশ। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বিশ্ব পুঁজিবাদকে সাবধান করে দেয় এর গতি-প্রকৃতি, সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো সম্পর্কে উল্লেখিত প্রতিবেদনে মোটা দাগে কিছু তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এর আগের অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতিতে এক ধরনের নিম্নগামিতার সূচনা হয়েছে। এর পাশাপাশি ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫। বর্তমান অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৬.৭ শতাংশ হবে বলে প্রতিবেদনটিতে ধারণা করা হয়েছে। পাকিস্তানে ২০২৩-২৪-এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ২.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই হার ২.৮ এ উন্নীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শ্রীলংকায় ২০২৩-২৪-এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪.৪ শতাংশ। ২০২৪-২৫-এ এই প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। উপমহাদেশের ৪টি দেশের মধ্যে ২টি দেশে প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী। দেশ দুটি হচ্ছে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা। শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক ধসের ফলে রাজনীতি টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। শ্রীলংকার রাজনীতিতে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসা রাজাপাকসে পরিবার বলতে গেলে ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হয়। রাজাপাকসে পরিবারের এ দুর্যোগের জন্য মূলত দায়ী শ্রীলংকার প্রধান অর্থনৈতিক খাত পর্যটন ও কৃষিতে বড় ধরনের বিপর্যয়। এ ছাড়াও ছিল কিছু প্রেসটিজ প্রজেক্টের বোঝা। শ্রীলংকার পর্যটন খাতে বিপর্যয়ের কারণ একটি দামি হোটেলে বিস্ফোরণের ফলে বহু পর্যটকের মৃত্যু হওয়ায় শ্রীলংকামুখী পর্যটকদের বিমুখতা। অন্যদিকে কৃষিতে পরিবেশগত বিপর্যয় রোধের নামে জৈব প্রযুক্তি প্রচলনের চেষ্টা দারুণ মার খায়। বোঝা যাচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতি বোধগম্য এবং অবোধগম্য কারণে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খুব নিচে নেমে যাওয়া থেকে ইদানীং পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কেন নিম্নগামী? শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ বছরে প্রবৃদ্ধি এর পূর্বেকার বছরের তুলনায় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। পূর্বেকার বছরগুলোতে ৬-৭ শতাংশ কিংবা তারও কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে ওই সময় বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোকে প্রবৃদ্ধির অংশ বাড়িয়ে দেখাতে প্রভাবিত করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর জন্য খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছিল। বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কার পেছনের কারণগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগে ভাটা, শিল্পখাতে ভাটার টান এবং অব্যাহত মূল্যস্ফীতি। সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ঘটেছে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। এ গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, যাতায়াত-পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পণ্যসামগ্রীর চলাচল ব্যাহত হয়েছে। কলকারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে গণ-অভ্যুত্থানের যে ঝড় বয়ে গেছে, তার ফলে অর্থনীতির বৃক্ষগুলোর ডালপালা ভেঙে গেছে, পাতাগুলো ঝরে গেছে।
২০২৪-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১০.৮৯ শতাংশ, ৫.২২ শতাংশ, ৪.১ শতাংশ এবং মাইনাস ১.৭ শতাংশ। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না, অথচ উপমহাদেশের অন্য দেশে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? তার একটা বড় কারণ শেখ হাসিনার আমলে অনেক মেগাপ্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এগুলোর সবকটি অবকাঠামো সম্পর্কিত। এসব প্রকল্পের জন্য ব্যয় হয়েছে বিশাল অঙ্কের অর্থ। শুধু তাই নয়, ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ বিশ্বের অন্য দেশে (অতি উন্নত দেশগুলোসহ) সমজাতীয় প্রকল্পের ব্যয়ের তুলনায় ২ কী ৩ গুণ বেশি। এর ফলে একদিকে প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক Sustainability প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অন্যদিকে এগুলো থেকে সুবিধাভোগীরা মেগা দুর্নীতির সুযোগ পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে মূল্যস্ফীতি উৎসারিত হয়। কারণ এগুলোর বাস্তবায়নে অনেক সময় লাগে এবং এগুলোর বাস্তবায়নকালে বাজারে বিপুল বর্ধিত আকারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসব প্রকল্প থেকে বেনিফিট অনেক ধীর গতিতে আসে, যার ফলে বাজারে যে পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতি হয়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য ও সেবা সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি খুব কম হারেই হয়। এর ফলে দেখা দেয় Too much money chasing too few goods. অর্থাৎ দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি বা Inflation. শেখ হাসিনার শাসনামলেই মূল্যস্ফীতি বল্গাহীন হতে শুরু করে। তবে পরিসংখ্যানের কারসাজি করে মূল্যস্ফীতির হার কম করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে মানুষের কষ্ট কমেনি। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, টাকা ছাপিয়ে সরকারের দায় পরিশোধের চেষ্টা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও রেড জোনে থাকা কয়েকটি ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য টাকা ছাপাতে হয়েছে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে বলে ধারণা করি। কারণ, শুনেছি ব্যাংকের গভর্নর এ পদক্ষেপের সঙ্গে সম্মত ছিলেন না। শত শত আমানতকারীর বিক্ষোভ এড়াতে এ রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর পদক্ষেপ নিতে হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিপর্যস্ত
- অর্থনীতি
- জিডিপি প্রবৃদ্ধি