পুলিশ সংস্কারের সুপারিশ: যা কিছু বাদ পড়ে গেল
১৫ জানুয়ারি পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ চারটি কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। জুলাই অভ্যুত্থান দমনে ছাত্র–জনতার বিপক্ষে পুলিশের সহিংস ভূমিকার কারণে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও জবাবদিহিহীনতার মতো বিতর্কিত বিষয় জড়িয়ে থাকে পুলিশ নিয়ে যেকোনো আলোচনায়। এগুলোসহ সামগ্রিকভাবে এই বাহিনী নিয়ে জনমনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো কতখানি প্রতিফলিত হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা জরুরি।
পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হওয়ার পর কিছু বিষয় জনপরিসরে বা পত্রপত্রিকায় বেশি আলোচিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পুলিশে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে কমিশনের রিপোর্টের ৪ নম্বর সুপারিশে ‘প্রভাবমুক্ত’ পুলিশ কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও কার প্রভাব থেকে পুলিশ কমিশন মুক্ত হবে, সেটা একেবারেই পরিষ্কার করা হয়নি।
বরং খসড়া প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘স্বাধীন’ পুলিশ কমিশনে জাতীয় সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুজন করে সদস্য থাকবেন। কেন তাঁরা থাকবেন, তাঁদের পদ বা দায়িত্ব কী হবে, কীভাবে তাহলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ১২ নম্বর সুপারিশেও কিছু বলা হয়নি। অথচ পুলিশের দুর্নীতি প্রতিকারে ৭ নম্বর সুপারিশে একটি ‘সর্বদলীয় কমিটি’র ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সর্বদলীয় দলে কারা কী প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই।
আরও দুশ্চিন্তার বিষয় আছে। এই খসড়ায় পুলিশের বর্তমান পুরস্কারকাঠামোর (৭.৩) এবং পদায়ন ও পদোন্নতিতে ‘সততা ও নিষ্ঠা’র (৮.৩) সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি। তাই প্রণোদনা ও উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন ও বিধিমালা অপব্যবহারের যে অভিযোগ রয়েছে, তা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেই বর্তমান সুপারিশমালায়।
এবার বলা যাক আটক বা গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদবিষয়ক (সুপারিশ ২) সুপারিশ নিয়ে। যেমন ২.১০ অনুযায়ী, আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআর–বহির্ভূত আসামিকে (শব্দটা হওয়া উচিত ছিল ‘অভিযুক্ত’) গ্রেপ্তার করা যাবে না বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তার না করলে, আদেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। তখন দায় পড়বে ঘুরেফিরে সেই পুলিশের কাঁধেই।
সুপারিশ ২.১২ অনুযায়ী, অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নামে মামলা না দেওয়া গেলে, তা যদি কোনো একটা ক্লু-লেস অপরাধ হয়, তাহলে কি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মামলা নেওয়া যাবে না? যদি তা–ই হয়, এ ক্ষেত্রে তা ৫.২–এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি ধারা হয়ে যাচ্ছে। সেখানে মামলার এফআইআর গ্রহণে কোনোরূপ বিলম্ব বা অনীহা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
সুপারিশ ২.১৩ অনুযায়ী বিচারপ্রক্রিয়ায় চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমের সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না বলা হয়েছে। এটি একটি পরিচ্ছন্ন ভাবনা। কিন্তু চূড়ান্তভাবে আপিল বিভাগের রায় পেতে অনেক সময় ১৫-২০ বছর সময়ও লেগে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে তাই এই সুপারিশের কার্যকারিতা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।