‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়
সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’-এর ব্যানারে হামলা ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত। গত ১৫ জানুয়ারি পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে এই হামলায় জাতীয় পতাকা বাঁধা রড, লাঠি ও ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে নির্বিচারে পিটিয়ে কমপক্ষে ১৮ জন আদিবাসী ছাত্র-জনতাকে আহত করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সাড়ে চার মাস আগে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামে যে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাদের অনেক সদস্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলার বাঙালি পরিবারের সন্তান। ধরণা করা হয়, এদের পেছনে রয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠীর ইন্ধন।
হামলার প্রকৃতি দেখে বলার অবকাশ নেই যে, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বরঞ্চ এই ঘটনা হচ্ছে একটি ধারাবাহিক ঘটনার সম্প্রসারিত রূপ। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে সেটেলাররা যেভাবে পাহাড়িদের ওপর হামলা এবং তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে— ওইসব হামলার সঙ্গে এই হামলাও একই সূত্রে গাঁথা। এনসিটিবির সামনে আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর হামলাও পুলিশের উপস্থিতিতে একইভাবে সংঘটিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যেমন আক্রান্তদের নিরাপত্তা না দিয়ে আক্রমণকারীদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে, এনসিটিবির সামনে হামলার সময়ও পুলিশের ভূমিকা তেমনটাই ছিল। হামলা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশের ব্যর্থতা নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার উদাহরণ।
এর আগে ঢাকায়, জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের হামলা সংঘটিত হয়নি। এনসিটিবির সামনের এই হামলা আদিবাসী নির্যাতনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্নতর মাত্রা যুক্ত করেছে। এ যাবৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা সমতলে আদিবাসীদের ওপর ভূমিদস্যু, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হামলা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। বলা যায়, রাজধানীতে যেখানে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ছড়াছড়ি এবং মানবতাবাদী নাগরিক সমাজের সরব উপস্থিতি— ওই নজরদারিত্বের মধ্যে আদিবাসীদের ওপর হামলা চালাতে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এর আগে সাহস করেনি। আদিবাসীরা নাগরিক সমাজের সহযোগিতায় ঢাকায় আপেক্ষিক শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল আয়োজন করে আসছিল এতকাল। তাই এনসিটিবির সামনে সংঘটিত এই হামলার একটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে এবং এই হামলার যোগসূত্র অনেক গভীরে প্রোথিত রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।
নাগরিক সমাজকে এই ঘটনাটি গভীরভাবে ভাবতে হবে। গোড়াতেই জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উত্থানকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের ওপর প্রচ্ছন্ন কালো ছায়া ফেলবে তা বলাই বাহুল্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এর আগে গত ১২ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাতিলের দাবিতে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও করেছিল। তাদের ঘেরাওয়ে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও পক্ষগুলোর সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ না করেই এনসিটিবি ওইদিন রাতেই পাঠ্যপুস্তকের অনলাইন ভার্সন থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি প্রত্যাহার করে নেয়। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এটা দেশে সাম্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায়।
নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে দেশের যে কোনো নাগরিকের বিক্ষোভের অধিকার প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তা গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এহেন চেতনা সংরক্ষণের দাবিতে গড়ে ওঠা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর হামলা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক এবং তা বিক্ষোভকারীদের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।
আদিবাসী জনগণের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ক দাবি পূরণের অধিকার তাদের মৌলিক অধিকার। স্বাধীন বাংলাদেশে যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ ও সভা-সমাবেশের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার চর্চায় কোনোভাবেই সহিংসতা বা হামলা বরদাশত করা যায় না। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলা জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রতি অবমাননা ও তাদের স্বপ্নের মুক্ত বাংলাদেশের ওপর আঘাতের সামিল। এ ধরনের হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এটা সুস্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক সেটেলারদের এ ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাবশালী একটি মহলের প্রচ্ছন্ন ইন্ধন ও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। ওই বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৯ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ নামে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের ব্যানারে সেটেলারদের সংগঠিত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। এনসিটিবির সামনে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার মিছিলের ওপর হামলায়ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই বিশেষ প্রভাবশালী মহলের ইন্ধন থাকতে পারে। বিশেষ ওই মহলের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্র জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যেতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- হামলা
- আদিবাসী গোষ্ঠী