এ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির মন্থর প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থনীতির হালচাল জানতে সম্প্রতি পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে, তিনি রাখঢাক ছাড়াই উত্তর দেন, ‘অর্থনীতির অবস্থা যে বেহাল, সেটা বোঝার জন্য বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। রাস্তাঘাটে ঘুরলে, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বললেই সেটা বোঝা যায়। শুধু গরিব কিংবা নিম্নবিত্ত নয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল না হওয়ায় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা—সবার মাঝেই একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতির সমান্তরালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও সবার মধে৵ উদ্বেগ আছে। ছিনতাই, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ গত কয়েক মাসে অনেকটাই বেড়েছে। অর্থনীতির গতিহীনতা বলি আর স্থবিরতা বলি, তার সঙ্গে নিরাপত্তা বোধের সম্পর্ক অস্বীকার করার জো নেই। বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান রয়েই গেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলার থেকে ১৫৯ কোটি ডলারে হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকাটা সচল রাখার জন্য দেশি বিনিয়োগই ভরসা। চাঁদাবাজি হলে, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হলে, ব্যবসায়ীরা কোন ভরসায় তাঁদের পকেটের টাকা বিনিয়োগ করবেন?
সম্প্রতি রাজধানীর মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে এক ব্যবসায়ীকে ১৫-২০ জনের সন্ত্রাসী দল কুপিয়ে আহত করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিপণিবিতানটির ৭০০ দোকানের ইন্টারনেট, পানি ও ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নগদ চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় তারা হামলাটি চালিয়েছিল। এর পেছনে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ছিল ‘পেশাদার অপরাধীরা তৎপর, উদ্বেগ’। প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধী সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। মুক্ত হওয়ার পর তাঁরা আবার বিভিন্ন এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, কাফরুল, পল্লবী, বাড্ডা, মহাখালী ও মতিঝিল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। নিয়মিত চাঁদাবাজি, তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, হুমকি-ধমকি দেওয়ার মতো অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে খোদ পুলিশের নেতৃত্ব উদ্বিগ্ন।
একসময় ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। সীমান্ত ভাগ করে তাঁরা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় থেকে খুনাখুনি এ রকম অপরাধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল। ২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ রকম ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তালিকাভুক্ত করেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর নানা সময়ের অভিযানে এ ধরনের অপরাধের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন নাগরিকেরা। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পান। এরপর তারা এলাকাভিত্তিক অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
এখানে প্রশ্নটি খুব সরল। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে যখন পুলিশি ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন কারা, কোন স্বার্থে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্ত করেছিলেন? পাঁচ মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাহলে কী করছে?
চাঁদাবাজি, অপহরণের সঙ্গে ছিনতাই এখন নগরবাসীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন বলছে, ‘বিশেষ অভিযানের মধ্যেই ঢাকার রাস্তায় ভীতি তৈরি করছে ছিনতাইকারীরা। ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে ১৫৯টি ছিনতাইয়ের ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত হয়েছে, নভেম্বর মাসে এ রকম ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৩৩। ২০২৩ সালের তুলনায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় হওয়া মামলার সংখ্যা বেড়েছে ১৮৫টি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে নাগরিকেরা পুলিশের কাছে যান না।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের স্পট চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গত বছরের শেষ চার মাসে ডিএমপির বিশেষ অভিযানে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সব পরিসংখ্যানই নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তৈরির জন্য যথেষ্ট।
স্বৈরাচারী সরকারের সময় পুলিশকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়ন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পুলিশকে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। পাঁচ মাস পরে এসেও সেই ধাক্কা পুলিশ এখনো সামলাতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যেমন মনোবলের ঘাটতি আছে, একই সঙ্গে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ও অপরাধ দমনে পুলিশ পুরোপুরি সক্ষম না হয়ে ওঠার সুযোগই নিচ্ছে অপরাধীরা।