
তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ কি কাগজেই থাকবে?
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর হাজারীবাগে ফিনিক্স লেদার কমপ্লেক্সে অগ্নিদুর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও ভবনের একজন মালিক জাহাঙ্গীর আলমেরই দেড় কোটি টাকার মেশিনারিজ পুড়ে গেছে (যুগান্তর)। আগের দিন (বৃহস্পতিবার) কক্সবাজারে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৩০০ শেল্টার পুড়ে গেছে এবং এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৬০০ শেল্টার পুড়ে যায়। প্রসঙ্গত, প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক অগ্নিকাণ্ড এবং প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, যার মধ্যে ২০২১ সালের ২২ মার্চ সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১ হাজারেরও অধিক ঘর পুড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের (এফএসসিডি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ১০২ জনের মৃত্যু ও ২৮১ জন আহত হওয়া ছাড়াও ৭৯২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুম অথবা পূর্ণাঙ্গ বৃষ্টিপাত শুরুর আগ পর্যন্ত এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। এফএসসিডির তথ্যমতে, গত ৭ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে এবং প্রায় ৩ হাজার মানুষের মৃত্য হয়েছে। তবে অনুমান করা যায়, এফএসসিডির এসব তথ্য তাদের নিজস্ব রেকর্ড অনুসারেই তৈরি। এর বাইরে প্রতিনিয়তই বাসাবাড়ি অথবা বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যা তারা নিজেরাই নিভিয়ে ফেলে বিধায় সেসব অগ্নিকাণ্ডের তথ্য এফএসসিডির রেকর্ডভুক্ত হয় না।
গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গত ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসাবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কথা বলা হলেও জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে এটি নাশকতা কিনা। গত মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) মধ্যরাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে তিনটি রিসোর্ট পুড়ে গেছে। জানা যায়, দ্বীপটিতে নিজস্ব কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, ফলে অগ্নিনির্বাপনের জন্য কোস্ট গার্ডের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। অথচ ২৩০টি ছোট-বড় হোটেল-রিসোর্ট এবং ২ সহস্রাধিক পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সেখানে স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা উচিত।
অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা গতানুগতিক। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং সবাই নড়েচড়ে বসে। পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের কিছুদিন আলোচনা চলে। প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পরই দুর্ঘটনার শিকার ভবন বা প্রতিষ্ঠানের নকশা না মানা, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় আসে; যেমন-হাজারীবাগ অগ্নিকাণ্ডের পর বলা হচ্ছে, ভবনটির কোনো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, ভবনটি আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ঘোষণা করা হয় ইত্যাদি। একইভাবে যখনই কোথাও কোনো ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তখনই এসব অনিয়ম আলোচনায় আসে। তদন্ত কমিটিও তাদের পর্যবেক্ষণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করে। কিন্তু সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সব আলোচনা ফিকে হয়ে যায়। গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছিল ৪৬ প্রাণ আর আহত হয়েছিল অনেক মানুষ। সেই দুর্ঘটনার পরও একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং অনেক সুপারিশ এসেছিল। কিন্তু এক বছর পার হতে চললেও সেসব সুপারিশের কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা জানা যায়নি। আমাদের মনে আছে, সে দুর্ঘটনার পর ঢাকাসহ সারা দেশেই রেস্টুরেন্টের অনুমোদন প্রক্রিয়াসহ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে অভিযান শুরু হয়। বন্ধ করা হয় অনেক রেস্টুরেন্ট। তবে শোনা যায়, পরে অনেক রেস্টুরেন্ট মালিকই ‘ম্যানেজ করে’ তাদের রেস্টুরেন্ট পুনরায় চালু করেছেন।