সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা জানতে চাই
রাজস্ব আয় বাড়ানোর সহজ পথ আছে, কঠিন পথও আছে। সহজ পথ হলো আমদানি শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো। আর কঠিন পথ আয়কর আদায়। সহজ পথেই গেল অন্তর্বর্তী সরকার। তবে প্রশ্ন হলো, অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হলো কেন, সরকার সহজ পথেই–বা কেন গেল, বিকল্প কিছু ছিল কি না?
দুই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। যেমন ১৯৭৫ সালের ৬ এপ্রিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা করে। এরপরের মাসে, ১৭ মে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সঙ্গে টাকার বিনিময়মূল্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এক পাউন্ডের দর ছিল ১৮ দশমিক ১৬ টাকা, বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা। অর্থাৎ একলাফে ৫৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন।
১৯৭৫ সালেই ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর দেওয়া ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি হ্রাসের অংশ হিসেবে সারের দাম বাড়ানো হয় এবং কৃষি খাতে কর আরোপ করা হয়।
২০০৫-০৬ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। বাজেট পাশের ঠিক ১ মাস ১৬ দিন পর রাজস্ব কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন তিনি। ৩ হাজার ৩৫২টি পণ্যের আমদানি শুল্ক দেড় থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়। বাজেট ছাড়াই শুল্ক কাঠামোয় এ ধরনের পরিবর্তন ছিল একটি বিরল ঘটনা।
২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল পাঁচবার, বিদ্যুতের দাম আটবার এবং পানির দাম পাঁচবার।
সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডলারের দাম, বৃদ্ধি পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট একলাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। সেটাই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডেকে আনার প্রথম সরকারি পদক্ষেপ। সেই যে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু, তা এখনো রয়ে গেছে।
সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে ৯ জানুয়ারি সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে শতাধিক পণ্যের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে।
এসব ঘটনার যোগসূত্র কোথায়
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওপরের ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে? সেটাই দেখা যাক। ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তাঁর নেওয়া দুটো সিদ্ধান্তই ছিল মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তপূরণ।
বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম ঋণ পায় ১৯৭৪ সালের ১৪ জুন, দ্বিতীয় ঋণ ১৯৭৫ সালের ২৮ জুলাই। এ নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২২ মার্চ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট ‘বাংলাদেশ: কারেন্ট ইকোনমিক পারফরম্যান্স অ্যান্ড শর্ট-টার্ম প্রসপেক্টস’-এ বলা হয়েছিল, ‘সরকার ১৯৭৫ সালের মে মাসে টাকার যে ৫৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে, তা আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৫ মালের ১ জুলাই বাস্তবায়ন শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবেই করা হয়েছে।’
১৯৭৫ সালেই ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছিল, ‘অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আইএমএফের যে কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, নতুন সরকার তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে। সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারগুলো হচ্ছে, ভর্তুকি কমানো, কৃষি খাতে কর আরোপ এবং আমদানি উদারীকরণ।’ পরে দেখা গেছে, এসব শর্ত পূরণও অব্যাহত ছিল।
২০০৫ সালে গণহারে আমদানি শুল্ক কমানোর পেছনে ছিল বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহায়তা ঋণের (ডিএসসি) ৩০ কোটি ডলার পাওয়ার শর্তপূরণ। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফুল সি প্যাটেল ওই বছরের ২১ জুলাই অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঋণ পেতে শুল্কহার কমানোর কথা বলেছিলেন। তারপরেই সেই সিদ্ধান্ত।