শ্বেতপত্র ও আমাদের করণীয়
শিক্ষার্থী জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন প্রণীত শ্বেতপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। কমিশনের শেতপত্র দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে, সেটা আমাদের জন্য যেমন হতাশার তেমনি এই শ্বেতপত্রের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো সবার মধ্যে একটি আশার সঞ্চারও করেছে।
এই শ্বেতপত্রে বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সীমাহীন দুর্নীতি, আর্থিক কারচুপি, অর্থ পাচার ও লুটপাটসহ নানাবিধ খাত চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটা খাতের বাস্তবিক এবং ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরা হয়। ব্যাংক সেক্টর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত প্রতিটা খাতের দুর্নীতির অসহনীয় অবস্থান এখানে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়।
অর্থনীতির প্রতিটা খাতের ভয়াবহ ভঙ্গুর দশা চিহ্নিত করা হলেও এই শ্বেতপত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাতটি প্রধান খাত চিহ্নিত করা হয়, যেখানে অতিসত্বর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে এই শ্বেতপত্রে প্রকাশ করা হয়। সেগুলো হলো অর্থনীতির মধ্যে স্থিরতা নিয়ে আসা; আসন্ন ২০২৫ এবং ২৬ সালের বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পরিষ্কার ধারণা তৈরি করা; ২০২৫ থেকে ২৭ সালকে বিবেচনায় নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং এর সাথে সম্প্রতি স্থগিত হয়ে যাওয়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যথাযথ মূল্যায়ন করা; অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ খাত চিহ্নিত করা; এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশে থেকে অধিকতর উন্নত দেশে উন্নয়ন) গ্রাজুয়েশনের জন্য শক্তিশালী নীতিমালা গ্রহণ; এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা দ্রুতগতিতে অর্জনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া; উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সংলাপের জন্য একটি ফোরাম তৈরি করা।
এটি বলার অপেক্ষায় রাখে না যে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য এই শ্বেতপত্রের নির্দেশিত পদক্ষেপগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ? একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রভাব কেমন হতে পারে এই দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ ক্রমশ টের পাচ্ছে। নিম্ন স্তরের মানুষ থেকে শুরু করে সব স্তরের মানুষ নানাভাবে এই ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বলী হিসেবে তাদের জীবনযাপন করে আসছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শ্বেতপত্র প্রণীত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেক্টরগুলোর পুনরুজ্জীবন এর কোনো বিকল্প নেই।
এই শ্বেতপত্রে সংস্কার প্রক্রিয়ায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যকার যে স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত বাধা রয়েছে তা থেকে উত্তরণ, যা দেশের সুশাসন ও অর্থনীতির একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরির জন্য অত্যাবশ্যক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়ার সাথে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই কমিশন সংস্কারের জন্য আরও ছয়টি খাত চিহ্নিত করে: ব্যাংক, এনার্জি এবং পাওয়ার, রাজস্ব, অবৈধ অর্থপাচার, রাষ্ট্রীয় খরচ বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্প এবং সামগ্রিক তথ্য ব্যবস্থাপনা।
এসব বাস্তবায়নের জন্য বৃহৎ এবং শক্তিশালী একটি প্রায়োগিক ও সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন করা অতিব জরুরি। গুরুত্ব বিচারে অর্থনৈতিক এসব সংস্কার প্রস্তাবনা সত্যিকার অর্থেই আমাদের অর্থনীতি একটি শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যেতে যে পারবে- সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব সংস্কার এবং প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা প্রস্তুত? কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে কতটা বদ্ধপরিকর এবং অতীত রাজনৈতিক চর্চা আমাদের তেমন ইঙ্গিত দেয় কি? কীভাবে পরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার এই প্রস্তাবনাগুলো তার রাজনৈতিক ম্যানিফ্যাস্টোর সাথে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা হাতে নেয়?– সেই বিষয়গুলোও গুরুত্বের সাথে জানা প্রয়োজন।