রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন শেখ রেহানা
গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লুটের কারিকরদের অন্যতম শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ সাল-পরবর্তী তিন বছরে বেসিক ব্যাংক লুটে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তুমুল সমালোচনা হলেও শেখ হাসিনা ছিলেন নির্বিকার। বিষয়টি নিয়ে এমনকি তৎকালীন সরকারের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। সে সময় তার খুঁটির জোর হিসেবে আলোচনায় এসেছিল ‘ছোট আপা’ বা শেখ রেহানার নাম। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে ‘ছোট আপা’ হিসেবে পরিচিত শেখ রেহানা।
কেবল বেসিক ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের বড় অনিয়মের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যকার আলোচনায় বারবার এসেছে শেখ রেহানার নাম। যদিও আওয়ামী লীগের দেড় দশকে বিষয়টি প্রকাশ্যে উচ্চারণের সাহস হয়নি কারো। বেসিকের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য চার প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সর্বেসর্বা ছিলেন শেখ রেহানা। তার সুপারিশেই এসব ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পদে নিয়োগ দিতেন শেখ হাসিনা। কিছু ক্ষেত্রে ডিএমডি বা জিএম পদে পদোন্নতি পেতেও শেখ রেহানার আশীর্বাদের প্রয়োজন হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, শেখ রেহানার পক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়মগুলো ঘটেছে মূলত সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের তদারকিতে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি হতে এ দুই ব্যক্তির কাছে লবিং করতেন প্রার্থীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজনের সুপারিশেই পদ পাওয়া যেত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের দুজনেরই সম্মিলিত সম্মতির প্রয়োজন হতো। চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম তারা শেখ রেহানার কাছে পাঠাতেন। শেখ রেহানার সুপারিশের পরই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগ দিতেন শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে জানতে গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক, এমডি, ডিএমডির দায়িত্ব পালনকারী এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়। নাম অপ্রকাশিত রাখার জোর অনুরোধ জানিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই।
তাদের ভাষ্য হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগের আগে সালমান এফ রহমান বা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ ঘুস দিতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে এ ঘুসের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে বড় ঋণগ্রহীতা বা করপোরেট গ্রুপগুলো পরিশোধ করত। এক্ষেত্রে শর্ত থাকত, চেয়ারম্যান-এমডি হওয়ার পর ওই অর্থ পরিশোধকারী গ্রুপকে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে বড় অংকের অর্থ তুলে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। পর্ষদে দুই-তিনজন প্রভাবশালী পরিচালক থাকতেন। রাজনৈতিক নেতা বা আওয়ামী পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত এসব পরিচালকের কাজ ছিল পর্ষদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বড় ঋণের প্রস্তাব পাস করে দিলে তারাও এ ঘুসের একটি অংশ পেতেন। তদবিরের বাইরে নিয়োগ পাওয়া পরিচালকদের দায়িত্ব কেবল পর্ষদ সভার কোরাম পূর্ণ করায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো বিষয়েই সৎ পরিচালকদের দৃঢ় অবস্থান নেয়ার সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে এভাবেই।