রাজস্ব আহরণে সংস্কার ও চ্যালেঞ্জ
মূলত এবং মুখ্যত নব্বইয়ের দশকেই বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু। ১৯৯১ সালের শুরুতে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশে ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির নবযাত্রা শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রথম বছরেই মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন পাস ও প্রবর্তিত হয়।
১৯৯২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লোকবল ও কর্মকাঠামোতে প্রথম সম্প্রসারণ ও সংস্কার আনা হয়। সে সময় বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদনব্যবস্থায় নতুন উদ্যম ও নতুন নতুন উদ্যোগ সংযোজিত হওয়ায় অর্থনৈতিক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ দশকেই তিনবার (১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯) ঘোষিত হয় সংশোধিত শিল্পনীতি। ১৯৯৩ সালে সিকিউরিটিজ অ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন, প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, সাউথ এশিয়ান প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং ফাইন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট পাস হয়।
১৯৯৪ সালে প্রথম সেলুলার ফোন পদ্ধতি চালু, ১৯১৩ সালের কম্পানি আইন প্রথম সংশোধন, টাকাকে চলতি হিসাবে লেনদেনের জন্য রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ৮ নম্বর আর্টিকলের মর্যাদা লাভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আইন ও বিধিমালা জারি হয়। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশরাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ (আইসিসিবি) গঠিত হয় এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাওয়ার সেল গঠন, গ্যাসাধার বিধিমালা জারি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন আইন পাস, প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি ঘোষণা।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি-নিয়ম পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায় উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়।
মূসক আইন প্রবর্তনসহ বেশ কয়েকটি রেগুলেটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় এবং সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জিডিপি ৫৯৭ বিলিয়ন থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে এক হাজার ২৫৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে দুই হাজার দুই বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয় এ দশকেই। ভোগ জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে যেখানে ছিল ৯৭ শতাংশ, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৭.৭ শতাংশ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৮২.৬ শতাংশে নেমে আসে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে জাতীয় সঞ্চয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১০.৭ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৮.০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১.৮-এ উন্নীত হয় এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১১.৮ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৭.৯ এবং ১৯৯৭-৯৮সালে ২১.৬-এ উন্নীত হয়। এর প্রভাব প্রতিফলন ঘটে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে—১৯৮৭-৮৮ সালে এনবিআর অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৯.৫ বিলিয়ন টাকা, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৬.৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৩৮ বিলিয়ন টাকায় বৃদ্ধি পায়।
কর রাজস্ব আয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালের ৮.৭ থেকে ১৯৯২-৯৮ সালে ৮.৮ শতাংশ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে তা ৯.৪ শতাংশে উন্নীত হয়। এরপর অবশ্য কর জিডিপি ও রেশিয়ো আর তেমন বাড়েনি। মূলত কাছাকাছি থাকে। এর অর্থ হলো অর্থনীতিতে আয়-ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কর রাজস্ব আয় সমানুপাতিক হারে বাড়েনি। সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু (এপিসেন্টার) সেখানেই।
নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৭-৮৮ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯২-৯৩ সালে তা তিন হাজার ৯৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে সাত হাজার ৫৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। অন্যদিকে যে রপ্তানি ১৯৮৭-৮৮ সালে এক হাজার ২৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, ১৯৯২-৯৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ, দুই হাজার ৩৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে রেকর্ড পাঁচ হাজার ১৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অতি প্রাগ্রসরমাণ এই তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে একটি দ্রুত গতিশীল অর্থনীতির এবং সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় আমদানি শুল্ক, আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর আহরণের ক্ষেত্র বিস্তৃতির অবকাশ। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য যে এই দশকে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ও মূসক তথা কাস্টমস বিভাগে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেলেও আয়কর বিভাগের আয়ে অগ্রগতি সমানুপাতে আসেনি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- চ্যালেঞ্জ
- সংস্কার
- রাজস্ব আহরণ