উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও শ্লথ প্রবৃদ্ধির কালে ‘মূসক’ কেন বাড়ানো হলো
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে যে দেশের ৪০টির বেশি পণ্য এবং সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (value-added tax) বা ‘ভ্যাট’ এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে। এই যেমন মিষ্টি কিনলে কিংবা পোশাক কিনলে অথবা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে বর্তমানের ৭ দশমিক ৫ শতাংশের করের বদলে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দিতে হবে। অর্থাৎ এক লাফে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে ‘মূসক’ বাড়বে উৎপাদন পর্যায়ের নানা পণ্যের ওপরও। বাড়বে বিমান ভাড়া এবং সেই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে ফলের রস এবং রঙের আমদানির ওপর।
মনে রাখা দরকার যে ‘মূসক’ বাড়ছে এমন একটা সময়ে যখন বাংলাদেশ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির অশ্বকে বাগ মানানো যাচ্ছে না এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৩ শতাংশ এবং সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ১১ শতাংশ। আমনের ভরা মৌসুমেও মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৩-৪ টাকা। এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ স্পষ্ট। প্রতিবেশী দেশগুলোয়ও মূল্যস্ফীতি কম। শ্রীলংকা দুই বছর আগের অর্থনৈতিক সংকটকালে দেশটির বিদ্যমান ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে বর্তমানে ১ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। ভারতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে এমনটা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ যা গত ১৫টি সিকিকালের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নতম।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন জাগে: এক. উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং শ্লথ প্রবৃদ্ধির কালে ‘মূসক’ কেন বাড়ানো হলো? দুই. ‘মূসক’ বৃদ্ধির ফলে বর্তমান মূল্যস্ফীতি কি আরো বেড়ে যাবে না এবং এ বৃদ্ধি কি বর্তমান নিম্ন প্রবৃদ্ধির হারকে আরো নিচে নামিয়ে আনবে না এবং তিন. আরো ‘মূসক’ আরোপণ কি দেশের অর্থঘাটতিকে কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে এবং এ ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য আর কি বিকল্প ছিল না?
প্রথমত. এটা সর্বজনবিদিত যে নতুন করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে দাতাগোষ্ঠী, বিশেষত আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের দেয়া শর্ত পূরণের জন্য। মোট ৪৫০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরই কর-জাতীয় দেশজ উৎপাদনের অনুপাত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের। তার মানে, টাকার অংকে ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব জোগাড় করতে হবে সরকারের। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের জন্য এমনতর শর্ত তো নতুন কিছু নয়।
আশির দশকে কাঠামোগত সাযুজ্য সুবিধার আওতায় নানা শর্ত এ আন্তর্জাতিক সংস্থাটি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ফলে বহু দেশ তাদের বাজেটের ভারসাম্য রক্ষা করতে তাদের নাগরিকদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করেছিল। আশির দশকে বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার বেশকিছু শর্ত তৎকালীন বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
নানা মহলে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে যে নতুন করে ‘মূসক’ আরোপিত হলে বাংলাদেশের চলমান উচ্চ মানের মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে কিনা। সরকার পক্ষ থেকে নিঃসংশয়ে বলা হচ্ছে যে তেমনটা হবে না। তাদের মতামতের পক্ষে অন্ততপক্ষে দুটো যুক্তি দেখানো হচ্ছে। এক. যেসব পণ্য বা সেবার ওপর ‘মূসক’ বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো ‘ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচকে’ অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং সেসব পণ্যের ওপর বর্ধিত করে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। এটি সত্যিকার অর্থে একটি গতানুগতিক বাস্তবতাবর্জিত কথা। দু-একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ। পোশাক সব ধরনের মানুষই কেনে—ধনীরা হয়তো ৫ হাজার টাকার, তবে সাধারণ মানুষও কেনে। এর ওপর বর্তমানে স্থিত ‘মূসক’ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি করলে সাধারণ মানুষের পকেটের ওপর চাপ পড়বে সন্দেহ নেই, ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকে সেটা প্রতিফলিত হোক বা না হোক। মিষ্টি বিষয়েও সেই একই কথা। সুতরাং পূর্বনির্ধারিত এসব পণ্যের ওপর ‘মূসক’ বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই, তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে, তা সেটা আংকিক মূল্যস্ফীতির সমীকরণে ধরা পড়ুক কিংবা না-ই পড়ুক।