নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন: নির্মোহ ইতিহাসচর্চা ও রাষ্ট্র সংস্কারের শিক্ষা
ইতিহাস এক অন্তহীন ঘটনাপ্রবাহের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্মৃতির পুনর্নিমাণ। এটি শুধু অতীতকে ধরে রাখে না, ভবিষ্যৎ গঠনের ভিত্তিও তৈরি করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইতিহাস কি নির্মোহভাবে লেখা যায়? আর যদি যায়, তাহলে সেই নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কি একটি নতুন বাংলাদেশের জন্য সংস্কার প্রয়াসের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব? বর্তমান বাংলাদেশের পটভূমিতে এ প্রশ্ন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
একটি দেশের ইতিহাস তার সংস্কার প্রয়াসের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। তবে বহুধাবিভক্ত একটি জাতির পক্ষে নির্মোহ ইতিহাস রচনা করা কি আদৌ সম্ভব, নাকি এটি একটি অলীক কল্পনা? এই নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাচর্চার (ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং) সুযোগ। শিক্ষাব্যবস্থা যদি ইতিহাসকে একমুখী কাহিনি হিসেবে নয়, বরং বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরে, তাহলে একটি জাতি তার অতীতকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
আমাদের পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার প্রচেষ্টাগুলো যদি ইতিহাসের সাবলীল বৈপরীত্য ও বহুমাত্রিকতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, তবে আমরা হয়তো সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে পারি। আর এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা হবে সেই হাতিয়ার, যা নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের নির্মোহ ও স্বচ্ছ পাঠের মাধ্যমে একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম করে তুলবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কেবল তথ্যের নিরপেক্ষ সংকলন নয়, এটি একধরনের নির্মাণ ও অব্যাহত বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। এটি গড়ে ওঠে বিশেষ কোনো দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক পটভূমি এবং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে। একজন শিকারির চোখ দিয়ে দেখলে জঙ্গলে গিয়ে বাঘ শিকারের ঘটনাকে বীরত্ব হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু বাঘের চোখ দিয়ে দেখলে সেটি নিছক অত্যাচার, অবিচার, নির্মমতা ও খুন। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যা একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে একেক রকম অর্থ ধারণ করে।
আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাসংগ্রাম, সামরিক শাসনের অধ্যায়, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা এবং সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টাগুলো এই বয়ান নির্মাণের উজ্জ্বল উদাহরণ। আগের এক লেখায় পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে ইতিহাসকে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রতীকী পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেছি। একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, ইতিহাস কখনোই একমাত্রিক নয়, এটি বহুমাত্রিক এবং প্রতিটি স্থানিক ও কালিক দৃষ্টিভঙ্গি তার নিজস্ব আঙ্গিকে সত্যকে তুলে ধরে।
এই বহুমাত্রিক ইতিহাস বোঝার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আরও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের শুধু তথ্য বা ঘটনা শেখানোর পরিবর্তে তাদের ইতিহাসের ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি বিচার–বিশ্লেষণ করতে শেখানো উচিত। এটি তাদের শুধু অতীতের ভুলগুলো বোঝার সক্ষমতা দেবে না, বরং ভবিষ্যতে একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার পথে তাদের চিন্তাশীল নেতৃত্ব বিকাশে সাহায্য করবে।
ঐতিহাসিক সত্য বিশ্লেষণে ইতিহাসচর্চার কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) নিয়ে ভাবতে গেলে ইহুদি ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী ইউভাল নোয়া হারিরি (১৯৭৬-) এবং জার্মান ইতিহাসবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক লিওপোল্ড ভন র্যাংকের (১৭৯৫-১৮৮৬) দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনায় আসা জরুরি। হারিরির ‘ইতিহাসের বড় ঘটনা’ (বিগ হিস্ট্রি) বৃহৎ কাঠামোর দিকে মনোযোগ দেয়, যেখানে ইতিহাসকে মিথের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়।
অন্যদিকে লিওপোল্ডের ‘ইতিহাসের ছোট ঘটনা’ (মাইক্রো হিস্ট্রি) ও নির্দিষ্ট সত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস পাঠের এই দুই কাঠামোর সমন্বয় জরুরি। বিগত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ইতিহাসের বড় ঘটনার দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখতে পাই মেগা প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে ইতিহাসের ছোট ঘটনার আলোকে আমরা দেখতে পাই গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ইতিহাস চর্চা
- রাষ্ট্র সংস্কার